1942 খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখো
ভূমিকা
1942-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতীয় জাতিয় সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সর্বশেষ ও সর্বভারতীয় গণ আন্দোলন’। গান্ধিজি পরিচালিত এই আন্দোলন ছিল সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
ভারত ছাড়ো প্রস্তাব
1942 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী সমিতির ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবে বলা হয় যে, শুধু ভারতের মঙ্গলের জন্যই নয়, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান এবং বিশ্বের নিরাপত্তার জন্যও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান একান্ত জরুরি। এই প্রসঙ্গে গান্ধিজি ঘোষণা করেন—‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’।
আন্দোলনের সূচনা
1942 খ্রিস্টাব্দের 8 আগস্ট রাতে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতির বিপুল ভোটে ভারত ছাড়ো প্রস্তাব পাস হয়। ঘোষণা করা হয় 9 আগস্ট থেকে সারা ভারত ব্যাপী ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হবে এবং ইংরেজ ভারত না ছাড়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। কিন্তু 8 আগস্ট মধ্যরাতে গান্ধিজি, জওহরলাল, প্যাটেল, জে বি কৃপালনি-সহ শীর্ষ নেতাদের ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পরদিন সকালে সারা ভারত গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে।
বিস্তার
কোনো শীর্ষ নেতা ছাড়াই জনগণ নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। (1) বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহাকুমায় এই আন্দোলন সবথেকে তীব্র আকার ধারণ করে। তমলুকে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে। এছাড়াও কলকাতা, ঢাকা, হুগলি-সহ বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। (2) বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, মুজাফফরপুর, যুক্তপ্রদেশের আজমগড়, জৌনপুর, গোরক্ষপুর প্রভৃতি জেলায় গান্ধিজির ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ধ্বনি জনগণকে স্বাধীনতালাভে ব্যাকুল করে। (3) বোম্বাই, আমেদাবাদ, পুনা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পাটনা, কটক, বেনারস প্রভৃতি স্থানে আন্দোলনকারীরা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
নেতৃবৃন্দ
গান্ধিজির ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যাঁরা দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনি, অজয় মুখার্জি, সুশীল ধাড়া প্রমুখ। এছাড়াও আসামের 13 বছরের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া ও মেদিনীপুরের তমলুকের 73 বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি
আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে গুলিচালনা, গ্রেফতার, জরিমানা, লাঠিচালনা, বেতের আঘাত এমনকি বিমান থেকে গোলাবর্ষণও করা হয়। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তান্ডব শুরু হয়।
ব্যর্থতার কারণ
ভারত ছাড়ো আন্দলন ব্যর্থতার পিছনে একাধিক কারণ দায়ী ছিল। যথা—
(1) শীর্ষ নেতৃত্বের অভাব : গান্ধিজি সহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ থাকায় এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত নেতা ছিলেন না।
(2) ঐক্যের অভাব : মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা কেউই আন্দোলন সফল করার জন্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি। এই দলগত ঐক্যের অভাব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।
(3) তীব্র সরকারি দমননীতি : ব্রিটিশের তীব্র দমননীতি আন্দোলনকে সফল হতে দেয়নি। দৈহিক নির্যাতন, গ্রফতার, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ধর্ষণ, এমনকি গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়।
(4) নেতৃত্বের কালবিলম্ব : 1942 সালের 14 জুলাই ভারত ছাড়ো প্রস্তাব গৃহীত হলেও আন্দোলন শুরু হয় 9 আগস্ট। এই সময়ের মধ্যে সরকার নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। নেতারাও এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। জওহরলালের চোখে এই অভ্যুত্থান ছিল ‘জনসাধারণের তাৎক্ষণিক উন্মাদনা’।
গুরুত্ব
আপাত দৃষ্টিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য।
(1) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের মর্যাদা ও প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
(2) এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ঐক্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে।
(3) এই আন্দোলন প্রমাণ করে ভারতীয়দের জাতীয় চেতনা কত গভীর। তারা শুধুমাত্র স্বাধীনতার জন্য সর্বপ্রকার আত্মত্যাগে প্রস্তুত।
উপসংহার
1942-এর আন্দোলন যেভাবে জাতীয় জাগরণ ঘটিয়েছিল ইতিপূর্বে তা আর দেখা যায়নি। তাই ঐতিহাসিক বরুণ দে’র মতে— “ভারত ছাড়ো আন্দোলন যেন ব্যর্থ হয়েও ব্যর্থ হয়নি”।
আরও পড়ুন – নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা