সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা
সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা রচনা
ভূমিকা
সাহিত্য মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী, চিরদিনের মুক্তি সোপান অজ্ঞতা থেকে, চিরন্তন মানসিক তৃপ্তির আধার। সাহিত্যে স্থান পায় অনির্বচনীয়তা যা কবি-সাহিত্যিকদের হৃদয়ে আসে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো-দূরাগত দৈববাণীর মতো। পার্থিব জীবনের দৈনন্দিন আটপৌরে ভাষার সাহায্যে কবি-সাহিত্যিকেরা চেষ্টা করেন তাকে রূপদানের। সেই অসীম অনন্ত অনির্বচনীয় ভাবেশ্চর্যকে আমরা যে ভাষায় দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি তার সাহায্যে রূপদান করা সহজ নয়, দুঃসাধ্য কাজ।
তাই মর্তের ভাব-ভাষা-চিন্তা-বাণীকে অমর্ত্যের ভাব-কল্পনার প্রকাশের উপযোগী করে তোলার জন্য তাতে কবি-সাহিত্যকরা আরোপ করেন নানা আকার-ইঙ্গিত, রূপক-অলংকার- যা হয়ে ওঠে ব্যঞ্জনাময়। কবি-সাহিত্যিকরা সৃষ্টির উল্লাসে মেতে মর্তলোক ও অমর্ত্যলোক, বস্তু-জগৎ ও ভাব জগৎ, সীমার সাথে অসীমের গড়ে তোলেন ভাব-মধুর ও রসসমৃদ্ধ অনবদ্য সেতু। সেই সেতুই সাহিত্য, যার সাহায্যে মর্ত্যে বস্তুবাদী মানুষের সার্থক উত্তরণ ঘটে অমর্ত্য লোকে। ভাব-কল্পনার রূপ-রস-গন্ধে ও অনাবিল আনন্দের-ধারাস্নানে ঘটে সাহিত্যে পাঠকের আত্ম-তৃপ্তি।
অনির্বচনীয়তার স্পর্শলাভ ও আনন্দানুভুতি
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ অনির্বচনীয়তা সম্বন্ধে বলেছেন, ‘নারীর যেমন শ্রী এবং স্ত্রী সাহিত্যের অনির্বচনীয়তা সেইরূপ। তাহা অনুকরণের অতীত। তাহা অলংকারকে অতিক্রম করিয়া উঠে, তাহা অলংকারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয় না।’ প্রকৃত সাহিত্য ‘সোনার হাতে সোনার চুড়ির মতো কে কার অলংকার, বোঝা কঠিন হয়। সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ হল ভাব-ভাষা, কাব্যময়তা, ভাষার মধ্যে ভাষাতীতের শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করা-রূপের মধ্যে অরূপের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা-রূপ ও রূপাতীতের মেলবন্ধন ঘটানো। অনির্বচনীয় পাঠক মনে প্রেরণ করে তার রসঘন অনির্বচনীয়তাকে।
কবি-সাহিত্যিকের মনোজগৎ, তাঁদের হৃদয় জগৎ, তাঁদের চিন্তার কল্প-রাজ্য সমৃদ্ধ অনুভুতির কোমলতা দিয়ে। তাঁদের হৃদয়-সাগরে, মন-জগতে, তাঁদের উপলব্ধি-অনুভূতির অনির্বচনীয় ক্ষেত্রের ভাব-তরঙ্গে অনির্বচনীয়তার ঘাত-প্রতিঘাতে সৃষ্টি হয় যে ভাব-স্পন্দন তার মাধুরীকে ভাষার আলংকারিকের নিবিড়তায় সংবিত্তি প্রদান করে পাঠকদের উপহার দেন কবি-সাহিত্যিক, মেতে থাকেন সৃষ্টির আনন্দে, পাঠক মেতে থাকেন তার থেকে জ্ঞানাহরণের আনন্দে। সাহিত্যিক কবির মধ্যে সৃষ্টি হয় পাঠকের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক। পাঠকের মন আপ্লুত হয় নব নব অনুভুতির রোমাঞ্চে, ভাব-রস-স্পন্দনে। পাঠক অবগাহন করে সাহিত্য-অমৃত সাগরে।
সাহিত্য পথপ্রদর্শক, জীবন ও আত্মপলব্ধির
সাহিত্যিক তাঁর ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবন ও জগতের সন্ধিতে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেন জীবনকে, মনের মনিকোঠায় আস্বাদন করেন যে অনির্বচনীয় আনন্দ-মধুর মদিরা, তা কাব্য-সাহিত্যে ছন্দোময় ও বাত্ময় হয়ে ওঠে। যা ছিল অধরা, যা ছিল ছোঁয়ার বাইরে, যা ছিল অসীম তা কাব্য-সাহিত্যে পাঠকের কাছে ধরা দেয় রস-ঘন-সীমাবদ্ধতায়। শিল্প ও সাহিত্যে যা ছিল বাইরের তা অন্তচারী হয়ে শিল্পী ও সাহিত্যিকের ‘আপন মনোমাধুরীর স্পর্শে রসোত্তীর্ণ’ শিল্প-সাহিত্যে স্থায়ীরূপ লাভ করে।
সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে পাঠক উপলব্ধি করেন নিজেকে, জগৎকে তথা নিজেকে। অজানার সাথে ঘটে পরিচয়, যেখানে পৌঁছতে পারে না সাধারণ মানুষ। সাহিত্যিক-কবি সেই জগতের অমৃতধারা এনে সাহিত্যের অমৃতপাত্রে নিবেদন করেন পাঠককে। জগৎ, জীবন ও আমাদের অন্তর-সত্তার পরিচয়-লাভের জন্য চাই একজন পথপ্রদর্শক, চাই এমন একজন, পাঠক মনোজগতের অভিসারী যার ভাব-রস-রসিকের রমণীয় সাহচর্যে পাঠক খুঁজে পাবে নিজেকে, নিজের সত্তাকে, অর্ন্তজগতকে, বর্হিবিশ্বকে। সাহিত্য সেই পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গোপনচারী অন্তরতম সত্তার রহস্যের দ্বারোৎঘাটন করে।
সাহিত্য হয় কালজয়ী অমর এক সৃষ্টি
সাহিত্যিক বিশেষ কোন সময়ে তাঁর সৃষ্টি- আনন্দে নিজেকে নিবেদিত করলেও তা হয় কালজয়ী ও চিরন্তন। মানুষ যদিও বস্তুবাদী তার মন হয় ভাববাদী। ভাবের সাগরে ডুব দিয়ে সাহিত্যিক-কবি তুলে আনেন অমূল্য মুক্তো, তার মালা গেঁথে উপহার দেন পাঠকদের। পাঠকের ভাব-চিন্তার নির্যাস হয়ে যুগ যুগ ধরে তা লাভ করে অমরত্ব। অমরত্ব-পিয়াসী মানুষ চায় একযুগের সৃষ্টি-সমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠ করে চিরকালের মনোহরণ-অমৃতের স্বাদ পেতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,’আমরা যে মূর্তি গড়িতেছি, ছবি আঁকিতেছি, কবিতা লিখিতেছি, পাথরের মন্দির নির্মাণ করিতেছি, দেশ বিদেশে চিরকাল ধরিয়া অবিশ্রাম এই-যে একটা চেষ্টা চলিতেছে, ইহা আর কিছুই নয়, মানুষের হৃদয় মধ্যে অমরতা প্রার্থনা করিতেছি’। সকলে চায় অমরত্ব। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে চিরকালের অমরত্ব-জ্ঞান-অমৃত কুম্ভের সন্ধানে ভেসে চলে পাঠক।
সাহিত্য দেয় সত্যের সন্ধান
মানুষ চায় নিজেকে মহান করে, সুন্দর করে গড়ে তুলতে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে এগিয়ে চলেছে সেই সত্যম্-সুন্দরম্ -অমৃতমের সন্ধান। সাহিত্যিক-কবি নিমগ্ন, তাঁদের সাহিত্য-সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠকদের তা উপহার দেওয়ার জন্য। যে সাহিত্যে নেই সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্ স্পর্শ সেই সাহিত্য হয় না কালজয়ী-চিরস্থায়ী। সাহিত্যকে চিরস্থায়ী হতে হলে তার মধ্যে পাঠক খুঁজে পাবে মানবকল্যাণের ধারা, সুন্দরের স্পর্শ, সার্বজনীনতা। সাহিত্যে কখনও কখনও অসুন্দরের অবতারনা করা হয় সুন্দরের পরিপূর্ণ রূপায়নের প্রয়োজনে। বাস্তবতার নামে অসুন্দরের আধিক্য সাহিত্যকে করে কলুষিত, সে সাহিত্য অপসৃষ্টির নামান্তর মাত্র। কবি-সাহিত্যিকরা অন্তদ্রষ্টা, তাঁরা হলেন ভোরের পাখি-নতুন দিনের আগমন-বার্তার শুভ-সঞ্চারী, অনাগত-যুগের অকথিত বাণীর মূর্ত-প্রতীক। সাহিত্য-সাধনার মাধ্যকে তাঁরা রচনা করে চলেছেন আগামী দিনের নব সভ্যতার-সংস্কৃতির রূপ-মূর্তির ভাস্বর রূপরেখা।
উপসংহার
সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা যেমন উপলব্ধি করতে পারি বর্তমানের স্বরূপ তেমনি উপলব্ধি করতে পারি গোটা বিশ্বকে। দেশ-দেশান্তরে সাহিত্যের মাধ্যমে চলছে মনুষ্যত্বের পূজো, তা সাহিত্য না পাঠকরে উপলব্ধি হতে পারে না। সেই সঙ্গে স্মরণীয় সাহিত্য পাঠেই শিক্ষা বিস্তারের সাফল্য।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা