মারাত্মক রোগ ক্যানসার ও তার প্রতিকার রচনা
ভূমিকা
ক্যানসার একটি মারণ রোগ। এই রোগে কেউ আক্রান্ত হয়েছে শুনলে মানুষ ভয় পায় এবং ভাবে যে হয়তো আর বেশীদিন সুস্থ থাকবে না, মৃত্যু তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। তাই মানুষ মনে করে ক্যানসার হওয়া মানে মৃত্যু অবধারিত। ডাক্তারি শাস্ত্রের অগ্রগতি হলেও বর্তমান শতাব্দীতে পৌঁছে ডাক্তার-বিজ্ঞানীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে ক্যানসার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সঠিক নিরাময় পদ্ধতি না আবিষ্কার হওয়ায়। তবে একথা ঠিক যে ক্যানসার সম্বন্ধে মানুষ সচেতন না হওয়ায় এই রোগ বেশী ছড়াচ্ছে। প্রথমাবস্থায় চিকিৎসা হলে অনেক ক্যানসার রোগী সুস্থ হয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যায় তার ছয় ভাগের একভাগ মানুষ মারা যায় ক্যানসারে। এখন শুধু ভারতে প্রায় ত্রিশ লক্ষেরও বেশী মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে যে প্রতিবছর পাঁচলক্ষের বেশী মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। ক্যানসার বলতে কী বুঝায়? মানুষের দেহের কোষ বৃদ্ধি হয় কোষ বিভাজনের ফলে। কোষ বিভাজন হয় নির্দিষ্ট নিয়মে ও নির্দিষ্ট অনুপাতে। কিন্তু কোনও কারণে দেহের কোন অংশে অস্বাভাবিক ভাবে কোষ বিভাজনের ফলে দেহের যখন ক্ষতি হয় তখন তাকে ক্যানসার বলা হয়।
কোষের অস্বাভাবিকও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধিই ক্যানসারের প্রধান কারণ। এক ফলে আক্রান্ত অংশ ফুলে টিউমারের আকার নেয় এবং ধীরে ধীরে দেহ কোষ বিনষ্ট হয়ে পচন শুরু হয়। শরীরের ভেতরে বা বাইরে টিউমার বা অর্বুদজাতীয় ক্রমবর্ধমান মাংসপিন্ডের উৎপত্তি স্বাভাবিক দেহ তত্ত্বকে বিনষ্ট করে। প্রাচীন কালে ও যে ক্যানসার রোগে মানুষ আক্রান্ত হত তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে দীর্ঘ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও ক্যানসার রোগ নিরাময়ের উল্ল্যেখযোগ্য ওষুধ ও ক্যানসারের পূর্ণস্বরূপ আবিষ্কৃত হয়নি। ক্যানসারকে ডাক্তারি ভাষায় কার্শিনোমা বলে। ক্যানসারের সঠিক কারণ অর্থাৎ এই রোগে কোন্ জীবাণু-ভাইরাস কাজ করে তা এখনও জানা যায়নি। যার ফলে ক্যানসার থেকে মানুষকে সহজে মুক্তকরা সম্ভব হচ্ছে না। ক্যানসার হওয়ার বেশ কিছু কারণ এখন পর্যন্ত জানা গেছে, যেমন, যারা বেশি ধূমপান করে তাদের ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা বেশি।
ক্যানসারের কারণ
আঘাত জনিত ক্ষত, অসুস্থ দাঁত, মাড়িতে ঘা, তামাক জাতীয় দ্রব্য যেমন বিড়ি, সিগারেট, চুরুট তামাক প্রভৃতি সেবন, দোক্তা, জর্দা, গুটখা, প্রভৃতির ব্যবহারে ক্যানসার হতে পারে। ক্রমাগত এক্সরে করার ফলে রেডিয়াম বিকিরণের জন্য ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে। কলকারখানার ধোঁয়া, আলকাতরা জাতীয় বস্তুর ব্যবহার, শরীরে আর্সেনিক জাতীয় বিষ প্রবেশ, বেঞ্জিন, ক্রোমিয়াম, নিকেল চূর্ণের ব্যবহারেও ক্যানসার হতে দেখা যায়। ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের প্রবণতা দেখা যায়। যেমন ভারতে মুখ, গলা, ফুসফুস সিকিম, ভুটান, নেপাল, দার্জিলিংয়ে গলা বা নাকের পেছনে, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়ায় লিভারে, চিন, জাপান, ফুসফুসে ক্যানসারের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
ক্যানসারের কোন বয়স ভেদ নেই। ক্যানসার শরীরের যেকোন স্থানে হতে পারে। রোটিনোব্লাস্টোমা ও পলিপোসিস অনেক সময় বংশগত বা জিনগত বলে মনে করা হয়। আবার কৃষ্ণাঙ্গদের তুলনায় শ্বেতাঙ্গদের চামড়ায় ক্যানসার বেশী হয়। প্রস্টেট, মেয়েদের মেমারি গ্লান্ড, ইউটেরাসে ক্যানসারের প্রবণতা দেখা যায়। বৃক্ষছেদন, বনজঙ্গল ধবংস, কলকারখানার ধোঁয়ার ফলে ক্ষতিকারক কার্বন জাতীয় বিষের আধিক্য প্রভৃতির জন্য প্রকৃতি ভারসাম্য হারাচ্ছে ও ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞের অভিমত।
ক্যানসার সৃষ্টিতে খাদ্যের ভূমিকা
ক্যানসার সৃষ্টিতে খাদ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন লোকে ফাস্টফুড যার মধ্যে ফ্যাট জাতীয় বস্তু বেশী আছে তা খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে, আমরা খাদ্য বলতে বুঝি শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন লবণ ইত্যাদি। এদের বেশীরভাগ খাদ্য ক্যানসার থেকে আমাদের রক্ষা করে। শিশুদের আজকাল পড়াশোনার এত চাপে রাখা হচ্ছে, যে খেলাধূলা করা বা দৌড় ঝাঁপ করার সময় পায় না।
আবার তেল জাতীয় খাবারের দিকে তাদের ঝোঁক বেশি, ফলে অল্প বয়সে শরীরে মেদ বৃদ্ধির জন্য ব্লাড প্রেসার উচ্চ হচ্ছে ব্লাড সুগার বাড়ছে, ধূমপান শুধু শরীরের ক্ষতি করে না তার থেকে ক্যানসারও হতে পারে। তামাকও গাড়ির ধোঁয়ায় পলিসাইক্লিক হাইড্রোকার্বন থেকে ক্যানসারের সম্ভাবনা আছে। পোড়া বা বেক জাতীয় খাদ্য, জলে আর্সেনিক বা অপরিস্রুত জল থেকে ক্যানসার হতে পারে। পোড়া খাদ্যে থাকে নাইট্রোসোমাইন যার থেকে ক্যানসার হতে পারে।আচার থেকে ক্যানসার সৃষ্টি হতে পারে।
ক্যানসার থেকে শরীর রক্ষা করে যেসব খাদ্য
ভিটামিন ও মিনারেল জল শরীরের ক্ষতি করে না। যেমন ভিটামিন এ,ই,সি, সেলোনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার ইত্যদি। টাটকা সব্জি, ফল, ডাল, ইত্যাদিতে প্রচুর ভিটামিন এ মিনারেল আছে। এই ধরনের খাবারকে বলে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ভিটামিন এ মুখের ক্যানসার প্রতিরোদ করে। ভিটামিন ই ফুসফুসের ক্যানসার থেকে রক্ষা করে। ভিটামিন ডি দিয়ে ও ক্যানসারের চিকিৎসা করা হয়। সোয়াবিনে লিউকোপ্লাকিয়া থাকায় ক্যানসারের প্রতিরোধক যা অ্যান্টি-অস্কিডেন্টের সমতুল্য। ভিটামিন সি থাকে লেবুজাতীয় খাদ্যে, আমলকি প্রভৃতিতে। টাটকা সব্জিতেও ভিটামিন সি থাকে।
ভিটামিন সি মুখের, গলার, পাকস্থলীর, কোলনের ক্যানসার থেকে রক্ষা করে। পলিপোসিস কোলাই বা জিনবাহিত খাদ্যনালীর রোগ থেকে ক্যানসার হতে পারে। ভিটামিন সি দিয়ে তার চিকিৎসা হয়। শব্জি খেলে কোলনের ক্যানসার প্রতিরোধ হয়। এ,বি,সি,ই, ভিটামিন একমাত্র মেলানোমা ক্যানসার ধবংস করে। ভিটামিন এ থেকে তৈরী অল ট্রান্সরেটিনোইক অ্যাসিড যা লিউকোমিয়া বা ব্ল্যাডপ্রেসার থেকে রক্ষা করে।
ক্যানসারের সংকেত
যদি কোনো ঘা স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে না সারে তাহলে ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকতে পারে। দেহের কোথাও যদি হঠাৎ মাংসপিন্ড সৃষ্টি হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া দরকার। দেহের কোনও অংশ থেকে অস্বাভাবিক রস বা রক্ত ক্ষরণ হলে সাবধান হতে হবে। দেহের কোথাও তিল, আচিল থাকলেও যদি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে তাহলে শীঘ্র চিকিৎসার প্রয়োজন। খাদ্যদ্রব্য খেতে যদি গলায় আটকায়, গলার স্বর হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যায় দীর্ঘদিন ধরে অবিলম্বে চিকিৎসার দরকার।
চিকিৎসা
কেমোথেরাপি করলে চুল পড়ে যায়, ভিটামিন ডি দিয়ে চিকিৎসা করলে চুল পড়া বন্ধ হয়। ক্যানসার সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বায়োপসি প্রয়োজন। ক্যানসার বা কার্সিনোমার সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা এখন হল কেমোথেরাপি এবং রে-ডি-এ-শান। শল্যচিকিৎসায় ক্যানসার অঙ্গ সুস্থ হতে পারে। ক্যানসার কোষগুলিকে মেরে ফেলতে বা বৃদ্ধি রোধ করতে বিকিরণ চিকিৎসা করা হয়। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি প্রভৃতি চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বারা ক্যানসার সারানো সম্ভব। তবে যথাসময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
উপসংহার
ক্যানসার সম্বন্ধে মানুষকে সচেতন করা খুবই প্রয়োজন এবং কি ধরনের খাদ্যাভ্যাস ক্যানসারে সহায়তা করে তা জানলে অনেকসময় ক্যানসার থেকে শরীরকে রক্ষা করা যেতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হু এর মতে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হচ্ছে যে তার এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এক-তৃতীয়াংশ ক্যানসার রোগী সুস্থ হয়ে যায়এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ রোগীকে এখনও সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না। এব্যাপারে সারা পৃথিবীতে নানা ধরনের গবেষণা চলছে।
সম্প্রতি আমেরিকার ডাক্তারা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেন। মেডিক্যাল জার্নেলে সেই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণা লব্ধ ফল প্রকাশের পরে জানা যায় যে মন্ত্র, জপ তপ, প্রার্থনা প্রভৃতির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সম্ভব, নানা ধরনের অসুখ নিয়ে ত্রিশটি স্টাডিতে পাওয়া গেছে যে ওষুধ না খেয়ে প্রার্থনার মাধ্যমে ৮৭% ক্যানসারের রোগী, ৮০% উচ্চরক্তচাপের রোগী, ৬৭% হার্টের রোগী দ্রুত নিরাময়ের পথে এগিয়ে গিয়েছে যা ওষুধেও সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা