ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো
ভূমিকা
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারতে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ব্রিটিশ সরকার নিজেদের প্রয়োজনেই ভারতে রেলপথ প্রবর্তন করে। রেলপথ স্থাপনের ক্ষেত্রে লর্ড ডালহৌসি অগ্ৰনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য
সম্পূর্ণভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইংরেজরা ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ভারতে রেলপথ স্থাপনের পিছনে ইংরেজদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী ও শোষণমূলক উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। যেমন —
(ক) কাঁচামাল রপ্তানি সহজ করা
ব্রিটেনের কারখানা গুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সেখানে কাঁচামালের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাই ভারতের অভ্যন্তর থেকে কাঁচামাল দ্রুত বন্দরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে রেল যোগাযোগের প্রয়োজন হয়।
(খ) বিলাতি পণ্যের আমদানি সহজ করা
শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের কারখানা গুলিতে প্রচুর পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হতে থাকে। এইসব পণ্য ভারতের অভ্যন্তরে দূরদূরান্তের বাজার গুলিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হয়।
(গ) পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা
শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শিল্পপতিদের হাতে বিপুল পুঁজি সঞ্চিত হয়। তারা মনে করে যে, ভারতে রেলপথ চালু হলে রেললাইন, ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করতে পারবে।
(ঘ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ, সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য ও রসদ পৌঁছে দেওয়া প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতে রেলপথ স্থাপনকে অপরিহার্য বলে মনে করে।
(ঙ) সামরিক উদ্দেশ্য
লর্ড হার্ডিঞ্জ ও লর্ড ডালহৌসি ভারতে সামরিক প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে রেল পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
(চ) দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করা
ঔপনিবেশিক আমলে ভারত বারবার দুর্ভিক্ষ কবলিত হয়েছিল। দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলে দ্রুত খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার রেল যোগাযোগের প্রয়োজন উপলব্ধি করে।
রেলপথ স্থাপনের প্রভাব
রেলপথ প্রতিষ্ঠা ভারতের সামগ্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতের ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে রেলপথ নির্মাণের গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই প্রভাব সদর্থক ও নঞর্থক উভয় ধরনেরই ছিল। যেমন —
(ক) সদর্থক প্রভাব
ভারতে রেলপথ স্থাপনের বিভিন্ন সদর্থক প্রভাব ছিল। যেমন —
প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা
রেলপথ স্থাপনের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য স্থাপিত হয় এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি আরও মজবুত হয়।
পরিবহনের আধুনিকীকরণ
রেলপথ স্থাপন হলে আধুনিক ও দ্রুতগামী পরিবহনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে দেশের দূরদূরান্তে দুর্ভিক্ষ ও খরার সময় খাদ্য পাঠানো খুবই সহজ হয়েছিল।
বাণিজ্য বৃদ্ধি
রেলপথের মাধ্যমে ভারতের আভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং এক অঞ্চলের পণ্য অন্য অঞ্চলে সহজেই সরবরাহ করা সম্ভব হয়। ফলে দেশের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি
রেলপথের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির সাথে সাথে ভারতে বিদেশি পণ্যের আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। রেল যোগাযোগের ফলে বন্দর থেকে ভারতের পণ্য সামগ্রী সহজেই আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দেওয়া যেমন সম্ভব হয় তেমনি বিদেশি পণ্য ভারতের বন্দর গুলি থেকে সহজেই দেশের বিভিন্ন বাজারে চলে আসে।
শিল্পের বিকাশ
রেলপথের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে কাঁচামালের জোগান দিয়ে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে লৌহ, ইস্পাত, কয়লা প্রভৃতি শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে। তাই কার্ল মার্কস বলেছিলেন, “রেলপথ ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্ৰদূত হবে।”
(খ) নঞর্থক প্রভাব
ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব রেল ব্যবস্থাকে সুনজরে দেখেনি। তাঁদের মতে, ভারতে রেলপথ বিস্তারের বেশ কিছু নঞর্থক প্রভাব ছিল। যেমন—
সম্পদের নির্গমন
রেল ব্যবস্থার মাধ্যমে সুদ ও মুনাফা হিসেবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে।
বর্ণবৈষম্য
রেলে ভারতীয়দের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত। পণ্য পরিবহনে শ্বেতাঙ্গ অপেক্ষা ভারতীয়দের বেশি ভাড়া দিতে হত। এমনকি কারণে অকারণে শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয় যাত্রীদের লাঞ্ছনা করত।
ভারী শিল্প ব্যাহত
ভারতে রেলপথ নির্মিত হলেও রেলের ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত। ফলে এদেশে ভারী শিল্পের বিশেষ প্রসার ঘটে নি।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য
রেল ব্যবস্থায় সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হত না। এইসব পদে শ্বেতাঙ্গদের নিয়োগ করা হত। ফলে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়।
দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব
রেলের মাধ্যমে দেশের খাদ্য দ্রব্য নির্বিচারে বিদেশে রপ্তানির ফলে উৎপাদক অঞ্চলে খাদ্যের ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
দেশীয় বাণিজ্যের সর্বনাশ
রেলের মাধ্যমে বিলাতি পণ্য ভারতের দূরদূরান্তের বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশীয় পণ্য সামগ্রী অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয় এবং ক্রমশ অবসানের পথে এগিয়ে যেতে থাকে।
শাসনের বজ্রমুষ্ঠি
সারা ভারত জুড়ে রেলপথ বিস্তারের ফলে ভারতবাসীর ওপর ব্রিটিশ শাসকদের বজ্রমুষ্ঠি আরও শক্ত হয়।
উপসংহার
ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থেই ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠা করে। মার্কিন ঐতিহাসিক বুকানন বলেছেন, “স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রাম গুলিকে এতদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের রেল সেই বর্ম ভেদ করে গ্রাম জীবনের রক্ত শোষণ শুরু করে দেয়।” তবে সার্বিক বিচারে রেলপথ বিস্তারের ফলে ভারতবাসী উপকৃতই হয়। ভারতের কৃষি ও শিল্পের বিকাশ রেলের মাধ্যমেই সম্ভব হয়। তাই রেলপথ প্রতিষ্ঠা ভারতীয় অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলেছিল তা মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে হয়।
আরও পড়ুন – শৈশবের স্মৃতি রচনা