পুঁইমাচা গল্পের ঘটনাক্রম অনুযায়ী বিশ্লেষণ
সহায়হরি চাটুজ্জে উঠানে পা দিয়াই… সমাজে থাকতে হলে সেই রকম মেনে চলতে হয়।”
‘পুঁই মাচা’ গল্পের শুরুতেই বিভূতিভূষণ এক দাম্পত্যের ছবি এঁকেছেন। তারক খুড়ো গাছ কাটার ফলে যে রস হয়েছিল সেটা সহায়হরি নেওয়ার জন্য স্ত্রী অন্নপূর্ণাকে একটা ঘটি দেওয়ার অনুরোধ করলেন। অন্নপূর্ণা সেইসময় নারকেল তেলের বোতলে ঝাঁটার কাঠি পুরে যে সামান্য তেলটুকু বেরোয় সেটা মাথায় মাখছিলেন। সহায়হরির কথা তিনি গ্রাহ্যই করলেন না।
অন্নপূর্ণার এরকম আচরণ দেখে সহায়হরি ভীত হয়ে গেলেন। – দাম্পত্য অশান্তির একটা কালো মেঘ যে ঘনিয়ে আসছে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি তার। সহায়হরি তার মেয়ে ক্ষেন্তিকেও ডেকে কোনো সাড়া পেলেন না। অন্নপূর্ণা তখন সহায়হরিকে সমাজের কথা বলল যে, সমাজ অবিবাহিত ক্ষেন্তিকে নিয়ে আলোচনা করে। ক্ষেন্তির । আশীর্বাদ হয়েও বিয়ে হয়নি তাই গুজব উঠেছে বাগদী আর দুলে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে জন্ম কাটালে ভদ্রলোকের গাঁয়ে বাস করা যায় না। সমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হবে। সহায়হরি মাছ ধরে আর রস খেয়ে জীবন কাটালে সমাজ তো তাকে ছেড়ে দেবে না। বিভূতিভূষণ এখানে গ্রাম্য সমাজের এক উজ্জ্বল অথচ করুণ সামাজিক প্রথার ছবি তুলে ধরেছেন।
“সহায়হরি বিস্মিত হইয়া কি বলিতে যাইতেছিলেন… ক্ষেন্তি মা, এসব কোথা থেকে আনলি? ওঃ! এ যে…”
গ্রামের মানুষজন একঘরে করে দেবে এ সংবাদ অন্নপূর্ণা সহায়হরিকে বললে সহায়হরি বিস্মিত হয়ে গেল। চৌধুরীদের চণ্ডীমণ্ডপ এটাই ঠিক করল যে, সহায়হরিদের হাতের ছোঁয়া জল কেউ খাবে না। সহায়হরির চালচুলো নেই। গরীব মানুষ। বাড়িতে বছর পনেরোর মেয়ে ক্ষেন্তি। তাই গ্রাম্য সমাজ তাকে অতি সহজেই একঘরে করে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না। এইরকম অবস্থায় তিনি কালীময় ঠাকুরের নাম করলেও সহায়হরি তাতে গুরুত্ব দেয়নি।
অন্নপূর্ণার গলার স্বর উচ্চ হতেই সহায়হরি একটা কাঁসার ঘটি হাতে নিয়ে খিড়কীর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছে তখন দাঁড়িয়ে ক্ষেন্তি। গল্পে ক্ষেন্তির আবির্ভাব এই প্রথম।
“চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি মেয়ে… কেমন মোটা মোটা…”
চোদ্দো-পনেরো বছরের ক্ষেন্তি এবং তার বোনেরা দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করছিল। তাদের হাতে এক বোঝা পুঁই শাক। ডাঁটাগুলো
মোটা এবং হলুদ। রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল কেউ পাকা পুঁইগাছ উপড়ে ফেলে উঠোনের জঙ্গলে ফেলেছিল। ক্ষেন্তি সেটাই কুড়িয়ে এনেছে। তার অন্য বোন দুটির মধ্যে একজনের হাত খালি এবং অন্যজনের হাতে, পথে গয়া বুড়ির থেকে নেওয়া চিংড়ি মাছ। সেটা পুঁই পাতায় জড়ানো।
গয়া বুড়ি মাছ দেওয়ার আগে সহায়হরির ধারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ক্ষেন্তি তার বাবার পক্ষে দাঁড়িয়ে সহায়হরির দৈন্য অবস্থা চাপা দিয়ে বলে, তার বাবা দুটো পয়সা না দিয়ে পালিয়ে যাবে না। পুঁইশাকগুলোর উৎস সম্পর্কে ঘাটের ধারে রায় কাকার কথা স্মরণ করায় ক্ষেন্তি, যাতে বাড়িতে কোনো অশান্তি শুরু না হয়।
“অন্নপূর্ণা দাওয়া হইতেই অত্যন্ত… তাহাদের মাকে অত্যন্ত ভয় করিত।”
ক্ষেন্তির আনা পুঁইডাটাগুলি দেখে সংসার-অভিজ্ঞ অন্নপূর্ণা অতি সহজেই বুঝতে পারল এগুলি পাকা। যেগুলি দু-দিন বাদে ফেলে দিত, ক্ষেন্তিকে সেগুলোই নিয়ে যেতে বলেছে। ক্ষেন্তি যে কতখানি বোকা, সেটা অন্নপূর্ণা তার কথায় প্রমাণ করতে চেয়েছে। বয়সের দোহাই দিয়ে মেয়েকে বেরোতে অর্থাৎ পাড়াবেড়াতে বারণ করেছিল-কিন্তু ক্ষেন্তি সেটা শোনেনি। ক্রোধে আগুন অন্নপূর্ণা তখন সেই পুঁইডাটাগুলি খিড়কির পুকুরের ধারে ফেলে দিতে বলল।
ক্ষেন্তির ছোটো বোন সেই পুঁইডাটার বোঝা আঁকড়ে ধরে যেতে না পেরে কিছু ফেলেও দিল। কিছুটা ঝুলতে ঝুলতে গেল। অন্নপূর্ণাকে যে সবাই ভয় পায় এ ছবি অতীব স্পষ্টভাবে এঁকেছেন।
“কালীময়ের চন্ডীমন্ডপে সেদিন… দুই ভায়ের অভাব কী”
কালীময়ের চণ্ডীমণ্ডপে ডাক পড়ল ক্ষেন্তির বাবা সহায়হরির। চন্ডীমণ্ডপে আলোচ্য বিষয় ছিল ক্ষেন্তির বিয়ে। বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে না হওয়া সেই সময় গ্রাম্য সমাজের কাছে মুখ্য আলোচ্য ছিল। চণ্ডীমণ্ডপে কেষ্ট মুখুজ্যের কথা উঠে আসে। সেও সঠিক স্বভাবের পাত্রের খোঁজে ছিল কিন্তু পায়নি। তাই শেষে হরির ছেলেকে ধরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। যদিও ছেলেটি মনেরমতো হয়নি। এ প্রসঙ্গেই তেরো বছরের ক্ষেন্তির কথা এসেছে। সহায়হরি তখনই বলেছিল, ক্ষেন্তি এই শ্রাবণেই তেরোয় পড়বে।
ক্ষেন্তি ছিল ‘উচ্ছ্বগগু’ করা মেয়ে। তার আশীর্বাদ হয়ে গিয়েছিল। কালীময়ের যোগসাজসে শ্রীমন্ত মজুমদারের ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলেটি লেখাপড়া বিশেষ জানে না, তবে দিব্যি বাড়ি-বাগান-পুকুর আছে। কিছু ধানের জমিও আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে ক্ষেন্তির জন্য পাত্র হিসেবে সে বেশ যোগ্য।
“ইতিহাসটা হইতেছে এই যে… সে সম্বন্ধ ভাঙ্গিয়াছেন।”
আশীর্বাদ হয়ে যাওয়ার দিন কয়েক পরে সহায়হরি জানতে পারল মজুমদারের ছেলেটির চরিত্র মন্দ। কয়েক মাস আগে কি একটা করার ফলে গ্রামের এক কুম্ভকার বধূর আত্মীয়স্বজনের কাছে বেদম মার খেয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিল। শোনা যায়, মজুমদারের কাছে কালীময়ের অনেক দেনা ছিল। সেজন্যই এ বিয়ের ব্যাপারে কালীময়ের উদ্যোগ। এসব জেনে সহায়হরি মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছিলেন।
“দিন দুই পরের কথা… পুনরায় ধূপ ধূপ শব্দ আরম্ভ হইল।”
ক্ষেন্তি এবং সহায়হরির সম্পর্ক ছিল মধুর। একদিন সকালে উঠে ক্ষেন্তি এবং সহায়হরি অন্নপূর্ণার অনুপস্থিতিতে শাবল নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে চলে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল সিঁদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্নপূর্ণা যখন স্নান সেরে এল তখন মুখুজ্যে বাড়ির ছোটো মেয়ে দুর্গা তাকে ডাকতে এল নবান্নটা মেখে ইতুর ঘটগুলি বের করে দেওয়ার জন্য। যাওয়ার পথে একটা বন পড়ে। সেই বনের মধ্যেই সেদিন খুপ্ খুপ্ শব্দ শুনতে পেল দুর্গা এবং অন্নপূর্ণা।
“কাজ করিয়া ফিরিতে … মাথা খাওয়া কিসের জন্য”
দুর্গাদের বাড়ি থেকে কাজ সেরে ফিরতে দেরি হল অন্নপূর্ণার। ফিরে এসে দেখেন, ক্ষেন্তি স্নান করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এমন সময় সহায়হরি পনেরো-ষোলো সের ভারী একটা মেটে আলু নিয়ে হাজির হল। সামনে অন্নপূর্ণাকে দেখে বলছে, ও পাড়ার ময়শা চৌকিদার মেটে আলু নিতে অনুরোধ করেছে।
সহায়হরির এ মিথ্যেটা অন্নপূর্ণা অতি সহজেই ধরে ফেলল। দুর্গাদের বাড়ি যাওয়ার সময় বরোজপোতার বনের মধ্যে যে শব্দ শোনা গিয়েছিল, সেটা এ মেটে আলুর তোলার শব্দ। অন্নপূর্ণার সাড়া পেয়ে সেই শব্দ সাময়িক বন্ধ ছিল। সহায়হরিকে ভর্ৎসনার সুরেই বললেন, সহায়হরির তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে তাই মিথ্যা কথাগুলো যাতে আর না বলে। এই প্রসঙ্গেই ক্ষেন্তিকে মিথ্যা প্রসঙ্গে না জড়াতে অনুরোধ করলেন।
“সহায়হরি হাত নাড়িয়া, বরোজপোতায়… এ মেয়ে নিয়ে আমি কি করব মাত্র”
সহায়হরির বরোজপোতায় যাওয়ার সত্য ঘটনা যখন অন্নপূর্ণার সামনে উন্মোচিত হল, তখন সহায়হরি তার বিরুদ্ধে প্রমাণ নিয়ে আসতে লাগলেন। যদিও অন্নপূর্ণার কাছে তা ভিত্তিহীন হয়ে গেল। আধ ঘণ্টা পরে ক্ষেন্তি যখন স্নান সেরে বাড়ি এল, অন্নপূর্ণা ক্ষেন্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন মেটে আলু সহায়হরি এবং ক্ষেন্তি মিলে তুলে এনেছে কি না। ভীত ক্ষেন্তি চারদিকে চেয়ে দিশাহীন হয়ে গেল। কপালে ঘাম দেখা দিল। শেষে মায়ের কড়া ধমকের সামনে ক্ষেন্তি স্বীকার করল, সহায়হরি এবং ক্ষেন্তি দুজনে বরোজপোতার জঙ্গল থেকে মেটে আলু এনেছে।
মেটে আলু ক্ষেন্তি নিয়ে আসায় অসন্তুষ্ট অন্নপূর্ণা। বরোজপোতার বনে ক্ষেন্তি কেন মেটে আলু চুরি করতে গিয়েছিল-এ নিয়ে প্রশ্ন অন্তহীন। বিয়ের উপযোগী মেয়ে হয়ে নির্জন বনে যাওয়া এবং পরের আলু তুলে সেটাকে বাড়ি নিয়ে আসা অন্নপূর্ণা ভালোভাবে নেয়নি। গোঁসাইরা চৌকিদার ডেকে ক্ষেন্তিকে ধরিয়েই দিতে পারত।
“দু-তিন দিন পরে একদিন… ভাঙা টিনের তোরেঙ্গের মধ্যেই উহা থাকিত।”
দু-দিন বাদে বিকেলবেলা ক্ষেন্তি মাকে ডেকে নিয়ে গেল ভাঙা পাঁচিলের ধারে ছোট খোলা জমিতে। পাথরকুচি এবং কন্টিকারী-র জঞ্জালের মাঝে একটি পুঁইশাকের চারা কাপড়ের ফালির মধ্যে গ্রন্থিবদ্ধ হয়ে ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে আছে। যেন ভবিষ্যতের কোনো স্মারক হয়ে উঠেছে। অন্নপূর্ণা হেসে বললেন, পুঁইচারা পোঁতার এখন সময় নয়, তাতে ক্ষেন্তি তার পরমপ্রিয় পুঁই মাচাকে বাঁচাতে রোজ জল দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করল। স্মিতহাস্যে অন্নপূর্ণা বললেন তাহলে হয়তো বাঁচতে পারে; যদিও রাতে শিশির পড়ে।
গ্রাম্য অতীব শীতের এক ছবি ধরা পড়েছে এই অংশে। শীতের সকালে সহায়হরি দেখলেন তার দুই মেয়ে দোলাই গায়ে একমুঠো রোদের জন্য কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপতে কাঁপতে ক্ষেন্তি – মুখুজ্যেদের বাড়ি থেকে গোবর নিয়ে আসে। বয়স বাড়ার সঙ্গে – সঙ্গে ক্ষেন্তি সুশ্রী হয়ে উঠেছে। ক্ষেন্তির ঠান্ডা লাগার জন্য চিন্তিত – সে। হরিপুরের রাসের মেলা থেকে সহায়হরি আড়াই টাকা দিয়ে কালো সার্জের জামা কিনেছিলেন। তারপর সেই জামার উপর চলেছিল বারেবারে রিফু। জামাটি তোলা ছিল ভাঙা টিনের তোরঙ্গের মধ্যে। ক্ষেন্তির স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ার ফলে জামাটি আর হয় না। জামার – বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে স্বয়ং গৃহকর্ত্রী অন্নপূর্ণারও জানা ছিল না।
“পৌষ সংক্রান্তি।… প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজিতে লাগিলেন।”
পৌষ সংক্রান্তি নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। অন্নপূর্ণা একটা – বাটিতে চালের গুঁড়ো, ময়দা এবং গুড় দিয়ে পৌষ-পার্বণের আয়োজন করছিলেন। ক্ষেন্তি নারকেল কুরে দিচ্ছে। অন্নপূর্ণা প্রাথমিকভাবে ক্ষেন্তির সাহায্য নিতে রাজি ছিল না। কারণ, বনে বনে ঘোরার জন্য তার কাপড় শুচি না। শেষে ক্ষেন্তি মায়ের কাছে অনুরোধ করায় মা তাকে পার্বণের কাজে যুক্ত করল। ময়দার গোলা মাখা শেষ হলে রাধী হাত পাতলো মায়ের কাছে। মেজো মেয়ে পুঁটিও কম যায় না। অন্নপূর্ণার মেয়েরা গ্রামের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। তাই তারা অন্নপূর্ণার কাছে খবর আনে জ্যাঠাইমার আনা অনেকখানি দুধে রাঙাদিদি ক্ষীর তৈরি করছিল।
অর্থবান এবং অর্থহীনদের একটা বৈষম্য বিভূতিভূষণ উপস্থিত করেছেন এই গল্পে। পুঁটির আনা খবর শুনে ক্ষেন্তি বলে উঠল জ্যাঠাইমারা ব্রাহ্মণ নিমন্ত্রণ করেছিল সুরেশকাকু এবং তিনুর বাবাকে। তাই ও-বেলা পায়েস, ঝোল-পুলি, মুগতক্তি এসব হয়েছে। খেঁদি, পুঁটিকে বলেছিল, পাটিসাপটা করতে ক্ষীর লাগে। কিন্তু পুঁটির মা অন্নপূর্ণা নারকেলের ছাই দিয়েই পিঠে করে। ক্ষীরের পুর এবং নারকেলের ছাই-এ দুই বস্তুই স্পষ্টত প্রভেদ করে দিয়েছে একই গ্রামে বাস করা দুই পরিবারকে। ক্ষীরের পুর না হলে পাটিসাপটা হয় কি না-এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে তাই হিমশিম খেতে হয় অন্নপূর্ণাকে। অনেকসময় পরিস্থিতি মানুষকে নির্বাক করে দেয়।
“ক্ষেন্তি বলিল-খেদীর ও সব কথা… উঁচু কথা কখনো কেউ শোনেনি”
পিঠে এবং পাটিসাপটার গন্ধ মেখেই পৌষ-পার্বণের শুরু। খেদির কথা অনুযায়ী ক্ষীরের পুরের পাটিসাপটাই সবথেকে ভালো; কিন্তু ক্ষেন্তি সেটা মানল না। ক্ষেন্তির কথা অনুযায়ী খেঁদির ওদের বাড়িতে তাকে একবার ধরা ধরা গন্ধের পাটিসাপটা দিয়েছিল। ক্ষেন্তি দরিদ্র, কিন্তু তাই বলে মাথা নত করবে না। তাই নারকেল কোরা দিয়ে পাটিসাপটার গুণ তার কাছে অনেক বেশি।
অন্নপূর্ণার কাছ থেকে নারকেল কোরা নিয়ে অপূর্ব তৃপ্তিতে সে খেতে থাকল। অন্নপূর্ণাও মেয়েদের কাছে গরম গরম পাটিসাপটা পরিবেশন করার কথা বলল। ক্ষেন্তিকে বলল ওবেলার ভাত বের করে খেতে। মায়ের এ কথা শুনে ক্ষেন্তি মনঃক্ষুণ্ণ হল। পুঁটি তখন ক্ষেন্তিকে পিঠে-পাটিসাপটা খাবার কথা বলল, কারণ পুঁটি জানে ক্ষেন্তির কোন্টা প্রিয়। অন্নপূর্ণা দেখল ক্ষেন্তি প্রায় আঠারো-উনিশখানা পিঠে খেয়েছে। তারপরও তার খাবারে না নেই। অন্নপূর্ণা ক্ষেন্তির এই ভোজনপটু ছবি দেখে শান্ত মনে ভাবলেন-ক্ষেন্তি যার ঘরে যাবে, তাদের অনেক সুখ দেবে। নীরব, শান্ত ক্ষেন্তি শত দুঃখেও শত গাল খাওয়া সত্ত্বেও কোনোদিন মুখে চুঁ শব্দটি করে না।
বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরি … ক্ষেন্তিকে কি অপরে ঠিক বুঝিবে?”
গ্রাম্য সমাজের আলোচনা ছিল ক্ষেন্তির বিয়ে হচ্ছে না কেন বা কবে হবে-এ বিষয় নিয়ে। বৈশাখ মাসের প্রথমে সেই আলোচনাকে নীরব করে ক্ষেন্তির বিয়ে হল একজন দোজবরের সঙ্গে। পাত্রের বয়স প্রায় চল্লিশ। শহুরে। সিমেন্ট, চুন ও ইটের ব্যবসায়ী। জামাইয়ের বয়স বেশি বলেই অন্নপূর্ণা জামাইয়ের সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছিলেন। শেষে ক্ষেন্তির দু-হাত জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে তিনি নীরব থেকে গেলেন।
বাড়ির বাইরে আমলকীতলায় বেহারারা একবার বরের পালকি নামাল। প্রকৃতির মাঝেই অন্নপূর্ণা চেয়ে থেকে দেখলেন ক্ষেন্তির কমদামের বালুচরের রাঙা চেলির আঁচলখানা লুটোচ্ছে। অন্নপূর্ণা দেখল ভোজনপটু, নিরীহ, সেই অগোছালো মেয়েটি আজ পিতৃগৃহ ছেড়ে স্বামীগৃহে চলে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত অজানা ভয়ে অন্নপূর্ণার মন উদ্বেল হয়ে উঠল। অন্নপূর্ণা বুঝতে পারল না, ক্ষেন্তিকে কি সত্যি অপর মানুষে বুঝবে। এক অনন্ত প্রশ্ন তার চোখজুড়ে।
“যাইবার সময়ে ক্ষেন্তি চোখের জলে ঐ কোনটা ছিঁড়ে … একটুখানি।”
বাঙালি সমাজে কন্যা বিদায় এক অতিপরিচিত ঘটনা। ক্ষেন্তির বিদায়ের সময় ক্ষেন্তির চোখের জল মনে করিয়ে দেয় কন্যাবিদায়ের চিরাচরিত ছবি। ধরা গলায় যে অন্নপূর্ণাকে বলেছিল, সহায়হরি আষাঢ় মাসে যেন ক্ষেন্তিকে নিয়ে আসে। ও পাড়ার ঠানদিদি ক্ষেন্তিকে আনতে যাওয়ার প্রসঙ্গে ক্ষেন্তির সন্তান জন্মের কথা বলেছিল। গ্রামবাংলার রীতি অনুযায়ী, সন্তান জন্মের পর মেয়ে আসে পিতৃগৃহে-এই ইঙ্গিতই স্পষ্ট।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে উঠোনের মাচায় রোদে দেওয়া আমসত্ত্ব তুলতে তুলতে অন্নপূর্ণার মনে ভেসে আসে ক্ষেন্তির কথা। এই তো সেদিন পর্যন্ত মায়ের কাছে লজ্জাহীনার মতো হাত পেতে মিনতির সুরে বলত একটুখানি আমসত্ত্ব দেওয়ার জন্য। অন্নপূর্ণার স্মৃতিপথে শুধুই আজ ক্ষেন্তির ছবি।
“এক বছরের উপর হইয়া গিয়াছে … কিছুক্ষণ দু’জনের কোনো কথা শুনা গেল না।”
সময় কেটে যায় দ্রুতলয়ে। এক বছর অতিক্রান্ত। আষাঢ় মাস সমাগত। ঘন বর্ষা। ঘরের দাওয়ায় বসে সহায়হরি বিন্নু সরকারের সঙ্গে আলাপরত। সহায়হরি বলে চলে তার দুর্ভাগ্যের কথা। ক্ষেন্তিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার কাছে আসতে দেয়নি। বরপক্ষ যে পণ চেয়েছিল সেটা সবটা দিতে সহায়হরি সক্ষম হয়নি। বাকি ছিল আড়াই’ শো টাকা। সহায়হরি যদি পুরো টাকা দিত তাহলে মেয়ে নিয়ে যাওবার কোনো অসুবিধে ছিল না। টাকা বাকি থাকায় ক্ষেন্তির নামে নিন্দা রটানো হল। ক্ষেন্তির ছোটোলোকের মতন ব্যবহার, হাভাতের মতো খাওয়া-এরকম আরও অনেক কিছু ক্ষেন্তির নামে বলতে শুরু করল ক্ষেন্তির স্বামীগৃহের মানুষজন। কন্যাপ্রিয় পিতা সহায়হরি ক্ষেন্তির কথা আলোচনা করতে করতে হুঁকোয় টান দিতে লাগলেন। হুঁকোর শব্দে চাপা পরে গেল আলোচনা।
অল্পক্ষণ পরে বিষু সরকার বলিলেন… মুড়ির চার তো সুবিধে হবে না।”
সহায়হরি এবং বিয়ু সরকারের কথোপকথনে ক্ষেন্তির অসহায়তার কথা উঠে আসে। ক্ষেন্তির শাশুড়ি পুরো পণ না পাওয়ার জন্য শুনিয়ে শুনিয়ে অনেক কথা বলতে থাকেন। সেই কথা কখনোই ক্ষেন্তির প্রশংসা নয়। সহায়হরিকে ছোটোলোেক বলতে তারা দ্বিতীয়বার ভাবেননি। পৌষ মাসের দিন সহায়হরি খালি হাতে মেয়েকে দেখতে গেলে তারা কথা শোনাতে ছাড়েনি। সহায়হরিরও বংশগৌরব ছিল। তার পিতৃপুরুষ পরমেশ্বর চাটুজ্যের নামে নীলকুঠি আমলে বাঘে- গোরুতে এক ঘাটে জল খেত।
শ্বশুরবাড়িতে থাকার সময় ক্ষেন্তির বসন্ত হয়েছিল। ফাল্গুন মাস। বসন্ত গায়ে বেরোতেই টালায় সহায়হরির দূর সম্পর্কের বোনের কাছে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সহায়হরিকে কোনো সংবাদ জানানোর প্রয়োজন তারা বোধ করেনি। ক্ষেন্তিকে টালায় পাঠিয়ে দিয়েছিল কিন্তু বসন্ত রোগ হলেও গায়ের গয়না খুলে নিতে শ্বশুরবাড়ির লোক ভোলেনি। পণপ্রথার এক অভিশপ্ত ছবি ধরা পড়েছে এ ফ্রেমে। এরপর সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথা এসে পড়ে। সহায়হরির মাছ ধরার কথাও এসে গেল। পিঁপড়ের টোপে মুড়ির চারের সুবিধা অসুবিধার কথা এসে যায়। ক্ষেন্তির কথা চাপা পড়ে যায়।
“তারপর কয়েক মাস কাটিয়া গিয়াছে… দিদি বড়ো ভালোবাসত।”
পৌষ-পার্বণের সময় আবার ফিরে এসেছে। ঘুরে গেছে বছর। সন্ধ্যাবেলা অন্নপূর্ণা সরুচাকলি, পিঠের জন্য চালের গুঁড়োর গোলা তৈরি করছে। পুঁটি ও রাধী উনুনের পাশে বসে আগুন পোহাচ্ছে। শীত মারাত্মক। ক্ষেন্তির অনুপস্থিতিতে পুঁটি ও রাধী অন্নপূর্ণার সহকারিণী। অন্নপূর্ণা গোলা তৈরি করে আগুনে চড়িয়ে মুচি দিয়ে চেপে ধরলেন। মিঠে আঁচে পিঠে টোপরের মতো ফুলে উঠল। পুঁটি তখন মা অন্নপূর্ণাকে বলল প্রথম পিঠে ষাঁড়া ষষ্ঠীকে ফেলে দিয়ে আসার জন্য।
পুঁটি ও রাধী খিড়কি দরজা খুলে বাড়ির পেছনে ষাঁড়া গাছে ঝোপের মাথায় পিঠে ফেলে দিয়ে এসেছিল। পিঠে করতে করতে রাত বেড়ে গেল। জ্যোৎস্নার আলো আর কাঠঠোকরা পাখি এক মায়াময় জগৎ সৃষ্টি করেছিল। কলার পাতা চিরতে চিরতে তাদের মনে এল ক্ষেন্তির কথা। দিদি পিঠে ভালোবাসত, যে দিদি তাদের মনের পুরোটা জুড়ে ছিল।
“তিনজনেই খানিকক্ষণ নির্বাক… জীবনের লাবণ্যে ভরপুর।”
গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে ক্ষেন্তির অসহায় মৃত্যুর এক ছবি বিভূতিভূষণ আঁকলেন। ক্ষেন্তি মারা গেলেও পুঁই গাছ লোভী ক্ষেন্তির বাসনাকে লালন করেছে। বাঁচিয়ে রেখেছে। পুঁই গাছের প্রবর্ধমান জীবনের রূপকে ধ্বংসের বিপরীতে সৃষ্টিকে চরম সত্য বলে প্রতিস্থাপন করেছে। প্রকৃতির কোলে বেড়ে-ওঠা মেয়ে ক্ষেন্তি। তাই বেড়ে-ওঠা পুঁই গাছ শেষপর্যন্ত ক্ষেন্তিরই জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির কোলে যাকে প্রাথমিকভাবে ধ্বংস মনে হয়, তা বোধহয় রূপ পরিবর্তনেরই অংশ মাত্র। ধ্বংস বেদনা ও বিষাদের ছায়া হাঁটতে থাকে পরস্পরের সঙ্গে।
আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য আলোচনা করো