|
ভারতীয় নীতিতত্ত্বে পরমপুরুষার্থ হিসেবে মোক্ষের ধারণাটি ব্যাখ্যা করো |
ভারতীয় নীতিতত্ত্বে পরমপুরুষার্থ হিসেবে মোক্ষের ধারণা
ভারতীয় নীতিশাস্ত্রে যে চারটি পুরুষার্থের কথা বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে মোক্ষই হল পরমপুরুষার্থ। সে কারণেই মোক্ষকে শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ বলা হয়। আর অপরাপর পুরুষার্থগুলি হল মোক্ষের সহযোগী মাত্র। মোক্ষ হল অবিদ্যা থেকে, জীবনযন্ত্রণা থেকে, ভবরূপ বন্ধন থেকে, আত্মার বন্ধন থেকে চিরমুক্তি। এই মুক্তি হল মানুষের জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে চিরমুক্তি। মোক্ষকে ভারতীয় দর্শনে মুক্তি, অপবর্গ, কৈবল্য, নির্বাণ, নিঃশ্রেয়স প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই মোক্ষ হল নিত্য পুরুষার্থ। একমাত্র চার্বাকগণই কাম-কে চরম পুরুষার্থ এবং অর্থ-কে গৌণ পুরুষার্থরূপে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন মীমাংসকরা ধর্মকেই পরমপুরুষার্থরূপে গণ্য করেছেন। এ ছাড়া আর অন্যান্য সমস্ত ভারতীয় দার্শনিকই মোক্ষকে শ্রেষ্ঠ তথা পরমপুরুষার্থের মর্যাদা দিয়েছেন।
মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য মোক্ষ
ভারতীয় দার্শনিকদের মতে, মোক্ষলাভই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। তাঁরা বলেন-মোক্ষার্থী ব্যক্তির জীবন অবশ্যই ধর্মভিত্তিকরূপে গণ্য হবে এবং সেক্ষেত্রে অর্থ ও কামেরও প্রয়োজন আছে। সে কারণেই ধর্ম, অর্থ ও কাম-কে মোক্ষলাভের সহযোগী পুরুষার্থরূপে গণ্য করা হয়। ভারতীয় দার্শনিকরা দাবি করেন যে, আমাদের জীবন হল মূলত অধ্যাত্মমুখী। এরূপ অধ্যাত্মমুখী যাত্রার পথে অধ্যাত্মবোধই হল আমাদের জীবনের চরম বৈশিষ্ট্য। আমাদের দৈনন্দিন ও ঐহিক জীবনযাত্রা এই অধ্যাত্মপথের এক-একটি সোপান মাত্র। এই সমস্ত সোপানকে পেরিয়ে তবেই আমরা চরম পুরুষার্থরূপে মোক্ষ-কে লাভ করতে পারি। ভারতবাসীরা তাই শুধু ঐহিক জীবনকেই কামনা করে না, তাঁরা ঐহিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাত্মজীবনেরও স্বপ্ন দেখে। এই আধ্যাত্মিক জীবনবহির্ভূত ঐহিক ও দৈনন্দিন জীবন তাই একেবারেই নিরর্থক। প্রত্যেকটি ভারতবাসীর তাই একমাত্র উদ্দেশ্য হল চরম ও পরম পুরুষার্থ তথা মোক্ষকে লাভ করা এবং জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে মোক্ষের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
বৌদ্ধ অভিমত
বৌদ্ধদর্শনে মোক্ষকে নির্বাণরূপে অভিহিত করা হয়েছে। এই নির্বাণ হল সমস্তপ্রকার দুঃখ থেকে চিরমুক্তির এক অবস্থা। বৌদ্ধমতে, অবিদ্যাই হল সমস্ত প্রকার দুঃখের মূল কারণ। সুতরাং বলা যায় যে, অবিদ্যার তথা অজ্ঞানের নাশই হল মোক্ষ বা নির্বাণ। বৌদ্ধদর্শনে স্বীকার করা হয়েছে যে, অবিদ্যা দূর হলেই তত্ত্বজ্ঞানের মাধ্যমে জীব ভবচক্র থেকে মুক্তিলাভ করে। এর ফলে জীব মোক্ষ তথা নির্বাণলাভে ধন্য হয়। বৌদ্ধমতে, নির্বাণ এই জীবনেই সম্ভব। সে কারণেই তাঁরা জীবন্মুক্তির বিষয়টিকে স্বীকার করে নিয়েছেন।
সাংখ্য ও যোগ অভিমত
সাংখ্যমতে পুরুষ বা আত্মার মুক্তির বিষয়টি নেহাতই অযৌক্তিক। কারণ, আত্মা হল স্বরূপত নিত্য, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাববিশিষ্ট। সে কারণেই বলা যায় যে, আত্মার কোনো বন্ধনই হতে পারে না। আর আত্মার বন্ধনের বিষয়টি যেখানে অবান্তর, সেখানে তার মোক্ষ তথা মুক্তির বিষয়টিও অবাস্তব। অবিদ্যাবশত আত্মা বা পুরুষ যদি তার নিজের স্বভাব বিস্মৃত হয়, তখনই তাকে বলা হয় আত্মার বন্দনদশা। অবিবেক তথা অবিদ্যাই হল এর মূল কারণ। পুরুষ ও প্রকৃতি যে আলাদা-এরূপ ভেদজ্ঞানই হল বিবেকজ্ঞান। এই ভেদজ্ঞান তথা বিবেকজ্ঞান দ্বারাই আত্মার মুক্তি বা কৈবল্যলাভ সম্ভব হতে পারে। সাংখ্যরা দু-প্রকার মুক্তির কথা বলেন-জীবন্মুক্তি ও বিদেহীমুক্তি। যোগ দার্শনিকরাও মোক্ষ সম্পর্কে সাংখ্যদের অভিমতকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। সে কারণেই মোক্ষ সম্পর্কিত যোগ দার্শনিকদের সাংখ্যের অনুগামীরূপে গণ্য করা হয়।
মীমাংসা অভিমত
প্রাচীন মীমাংসকদের মতানুযায়ী দাবি করা যায় যে, মোক্ষ কখনোই পরম বা শ্রেষ্ঠ পুরষার্থ নয়। তাঁদের মতে স্বর্গলাভের জন্য ধর্মই হল পরম বা শ্রেষ্ঠ পুরুষার্থ। বেদ-বিহিত যাগযজ্ঞের দ্বারাই ধর্ম সম্পাদিত হয় এবং তার দ্বারাই স্বর্গসুখ লাভ করা যায়।
ন্যায়-বৈশেষিক অভিমত
ন্যায়-বৈশেষিক মতে মোক্ষকে অপবর্গ তথা নিঃশ্রেয়সরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের মতে, চৈতন্য আত্মার স্বাভাবিক গুণ নয়, তা হল একটি আগন্তুক গুণ। আত্মা যখন মনের সঙ্গে, মন যখন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে, ইন্দ্রিয় যখন বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়, তখনই আত্মাতে ঘটে চৈতন্যের আবির্ভাব। অবিদ্যার প্রভাবে আত্মা নিজেকে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বলে মনে করে এবং সমস্তরকম জাগতিক দুঃখকষ্ট ভোগ করে। একমাত্র তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাই অবিদ্যা দূরীভূত হয় এবং তার ফলে নিঃশ্রেয়স তথা মোক্ষলাভ করা যায়।
অদ্বৈত বেদান্ত তথা আচার্য শংকরের অভিমত
অদ্বৈত বেদান্তীদের মতে, জীবই হল ব্রহ্ম এবং জীবাত্মই হল পরমাত্মা। জীবাত্মা যখন পরমাত্মারূপে নিজেকে উপলব্ধি করে, তখনই হয় তার মোক্ষ বা মুক্তি। বিশুদ্ধ জ্ঞানই হল মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়। বেদান্ত বাক্য শ্রবণ, মনন এবং নিদিধ্যাসনের মাধ্যমেই বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভ করা যায়। অদ্বৈত বেদান্তীরা জীবন্মুক্তি ও বিদেহী মুক্তি-উভয়প্রকার মুক্তিকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।
বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্ত তথা আচার্য রামানুজের অভিমত
বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী আচার্য রামানুজের মতে, জীবাত্মা ও পরমাত্মা অংশ এবং সমগ্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বরূপ। কারণ, তিনি বলেন-জীবাত্মা অণু পরিমাণ স্বরূপ এবং পরমাত্মা বিভু পরিমাণ স্বরূপ। আবার জীবাত্মা যেখানে অল্পজ্ঞরূপে গণ্য, সেখানে পরমাত্মা সর্বজ্ঞরূপে খ্যাত। অবিদ্যাবশত জীব নিজেকে পরমাত্মা তথা ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করে এবং একেই বলা হয় জীবের বন্ধনদশা। এই বন্ধনদশা থেকে মুক্তিলাভই হল মোক্ষ।