ভারতীয় চিন্তাধারায় কর্মের গুরুত্ব কী
ভারতীয় চিন্তাধারায় কর্মের গুরুত্ব কী |
ভারতীয় চিন্তাধারায় কর্মের গুরুত্ব
ভারতীয় চিন্তাধারায় এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে মানুষের কর্মের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে-তা অস্বীকার করা যায় না। কারণ, ভারতীয় চিন্তাধারায় এরূপ বিষয়টিই প্রতিফলিত হয় যে, কর্ম করলে তবেই তার নৈতিক বিচার সম্ভব। কর্ম না করলে নৈতিক বিচারের প্রশ্নটি একেবারেই অচল হয়ে পড়ে। ভারতীয় চিন্তাধারায় তাই কর্মবাদের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়েছে। কর্মবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা হয় যে, মানুষ যেমন কর্ম করবে তার ফল ঠিক সেইরূপই হবে। অর্থাৎ ভালো কর্মের জন্য ভালো ফল এবং মন্দ কর্মের মন্দ ফলকে স্বীকার করা হয়েছে। কৃতকর্মের ফল কখনোই বিনষ্ট হয় না। ভারতীয় কর্মবাদ অনুযায়ী স্বীকার করা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি কর্মের পিছনেই একটি কারণ আছে এবং কর্মের একই কারণ একই ফল প্রদান করে। কর্ম অনুযায়ী ফললাভই হল একটি সনাতন ভারতীয় রীতি। শুভ কর্মের ফল তাই শুভই হয় এবং অশুভ কর্মের ফলও তাই অশুভই হয়। শুভ কর্মের ফলে অশুভ ফল এবং অশুভ কর্মের ফলে শুভ ফল কখনোই উচিত নয়।
কর্মবাদ অনুযায়ী কর্মফল
ভারতীয় কর্মবাদের মূলকথা হল-কর্মের ফল অনুযায়ীই মানুষ তার ফলভোগ করে। কর্মফলের জন্যই তাই মানুষ দুঃখ-কষ্ট, সুখ-আনন্দ প্রভৃতি লাভ করে। মন্দ কর্মের জন্য মানুষ বিভিন্নরকম দুঃখকষ্ট ভোগ করে, আর ভালো কর্মের জন্য মানুষ সুখ-আনন্দ অনুভব করে। সেকারণেই স্বীকার করা সংগত যে, প্রত্যেকটি কর্মের ফল সুনিশ্চিত। ভারতীয় চিন্তাধারায় কর্মের এই ফল নৈতিকতার দৃষ্টিতে বিচারিত। সেকারণেই কর্মবাদকে ভারতীয় চিন্তাধারায় একটি সুশৃঙ্খল নৈতিক মতবাদরূপে গণ্য করা হয়। কর্মবাদের পরিপ্রেক্ষিতেই দাবি করা হয় যে, এই জাগতিক জগতের মধ্যেও একপ্রকার নৈতিক নিয়ম পরিলক্ষিত হয় যা কর্মবাদের প্রতি বিশ্বাস থেকেই নিঃসৃত। সেকারণেই উল্লেখ করা হয় যে, কর্মবাদ শুধু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রাকেই নিয়ন্ত্রিত করে না, তা সামগ্রিকভাবে জগৎ ও জীবনের শৃঙ্খলাকেও নিয়ন্ত্রিত করে। কর্মবাদ তাই এক অমোঘ নৈতিক নিয়মরূপেই গণ্য।
কর্মবাদের ধারণায় জন্মান্তরবাদ
কর্মবাদের স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে ভারতীয় দর্শন ও নীতিতত্ত্বে জন্মান্তরবাদকেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কর্ম ও কর্মফল অলঙ্ঘনীয় বলে প্রত্যেক মানুষকেই তার কৃতকর্মের জন্য ফলভোগ করতেই হয়। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, কর্মের ফল সঙ্গে সঙ্গেই ভোগ করতে হয়-এমনটি নাও হতে পারে। কর্মের ফল তাৎক্ষণিকভাবে লভ্য না-হলেও, তা সংরক্ষিত হয় এবং পরজন্মে তা সঞ্চারিত হয়। সেকারণেই বলা যায় যে, ইহজীবনে কর্মফল ভোগ না করলে, পরজন্মে সেই ফলকে ভোগ করতে হয়। কর্মফল ভোগ করার জন্যই মানুষকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। এভাবেই জন্ম-জন্মান্তরে কর্মফল সংক্রামিত হয়। পূর্বজন্মের কর্মফলহেতু বর্তমান জীবন নির্ধারিত হয় এবং বর্তমান জীবনের কর্মফলহেতু ভবিষ্যৎ বা উত্তরজীবন নির্ধারিত হয়। এভাবেই জন্মান্তরবাদের বিষয়টি ভারতীয় চিন্তাধারায় উঠে এসেছে। কর্মফলের জন্যই মানুষ এরূপ জীবন-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয়। বৌদ্ধদর্শনে একেই বলা হয় ভবচক্র।
অমোঘ নৈতিক নিয়মে কর্মবাদ
কর্ম এবং তার ফলের বিষয়টি ভারতীয় নীতিতত্ত্বে এক অমোঘ নৈতিক নিয়মে পরিণত। একমাত্র ভারতীয় চার্বাক সম্প্রদায় ছাড়া আর সমস্ত সম্প্রদায়ই এই অমোঘ নৈতিক নিয়মকে মেনে নিয়েছে। ঋগ্বেদ-এ এই অমোঘ নৈতিক নিয়মকে ঋতরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঋত মানুষের শুধু বাহ্যিক জীবনযাত্রাকেই নিয়ন্ত্রিত করে না, তা মানুষের আন্তরজীবনকেও নিয়ন্ত্রিত করে। এরূপ নৈতিক নিয়মবৃত্তের বাইরে আসা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সেকারণেই ঋগ্বেদে বলা হয়েছে-ঋতেন বিশ্বভুবনম্ বিরাজতঃ। কর্ম মানুষের ইচ্ছাসাপেক্ষ হলেও কর্মফল কিন্তু কখনোই ইচ্ছাসাপেক্ষ নয়। কর্মফল হল মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ। কামনাবাসনার সঙ্গে কর্ম সম্পাদন করলে তার ফল পাওয়া যায় এবং মানুষকে সেই কর্মের ফল ভোগ করতেই হয়। কিন্তু নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদন করলে তার কোনো ফলই পাওয়া যায় না।