পুরুষার্থ হিসেবে কাম-এর বিষয়টি আলোচনা করো |
পুরুষার্থ হিসেবে কাম
ভারতীয় চিন্তাধারায় কাম একটি অন্যতম পুরুষার্থরূপে গণ্য। কারণ, ভারতীয় দার্শনিকগণ মনে করেন যে, ধর্মাচরণের জন্য কাম-এর আবশ্যকতা আছে। কামের ফলশ্রুতিতেই জীবকুলের আবির্ভাব। আর জীব তথা মানুষ যদি না থাকে তাহলে ধর্মাচরণের বিষয়টিও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তাই মোক্ষলাভের বিষয়টিও এক্ষেত্রে অচল হয়ে পড়ে। মনুষ্যবিহীন সমাজে আর মোক্ষের কোনো তাগিদ থাকে না। একমাত্র কাম-সম্ভোগই মোক্ষলাভের তাগিদের ধারাটিকে বহন করতে পারে। সে কারণেই কামকে একটি অন্যতম পুরুষার্থ বা কাম্যবস্তুরূপে গণ্য করা হয়েছে। সুতরাং বলা যায় যে, মোক্ষলাভের কামনার ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখার জন্য কামের একান্ত প্রয়োজন।
দ্বিবিধ অর্থে কাম
সাধারণত কাম শব্দটির দুটি অর্থ করা হয়েছে। একটি হল এর সংকীর্ণ অর্থ এবং অপরটি হল এর ব্যাপকতম অর্থ। সংকীর্ণ অর্থে কাম শব্দটির অর্থ হল-যৌন সুখসম্ভোগের ইচ্ছা। এরূপ কামের দ্বারা শুধু ইন্দ্রিয়সুখই সম্ভোগ করা যায়। কিন্তু ভারতীয় নীতিতত্ত্বে এরূপ সংকীর্ণ অর্থে কাম শব্দটির উল্লেখ করা হয়নি। ভারতীয় নীতিতত্ত্বে ব্যাপকতম অর্থে কাম শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। এরূপ ব্যাপকতম অর্থেই কাম-এর অর্থ হল বুদ্ধিদীপ্তভাবে যে-কোনো প্রকার ইন্দ্রিয় সুখসম্ভোগ। সংকীর্ণ অর্থে যে যৌনসুখরূপে কামের কথা বলা হয়, সেরূপ কামকে কিন্তু পুরুষার্থরূপে গণ্য করা হয় না, কামকে যখন পুরুষার্থরূপে গণ্য করা হয়, তখনই তা হল-বুদ্ধিদীপ্ত সংযত কাম। এরূপ কাম শুধু দৈহিক সুখকেই নির্দেশ করে না, একইসঙ্গে তা মানুষের মননশীলতা ও বিচারশীলতাকেও নির্দেশ করে।
দ্বিবিধ বৃত্তিতে মনুষ্যবৃত্তি
সাধারণভাবে উল্লেখ করা যায় যে, মানবপ্রকৃতিতে দুটি বৃত্তি নিহিত আছে। এই দুটি বৃত্তির একটি হল জীববৃত্তি এবং অপরটি হল বুদ্ধিবৃত্তি। জীববৃত্তিকে বলা হয় পশুবৃত্তি এবং সে কারণেই জীববৃত্তির জন্য মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নিম্নতর জৈবিক সত্তা। এরূপ জৈবিক সত্তা মূলত দৈহিক সুখ পাওয়ার লালসায় উন্মত্ত। কিন্তু মানুষের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তির উপস্থিতি থাকায়, মানুষ সবসময় যৌন সুখসম্ভোগরূপ কামকে কামনা করে না। বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা মানুষ কামকে সংযতভাবে চালিত করে এবং মানুষকে মোক্ষাভিমুখী করে গড়ে তোলে। ভারতীয় সনাতন চিন্তাধারায় তাই শুধুমাত্র কামের জন্য কামাচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয়।
বুদ্ধিসঞ্জাত সংসারধর্মে কাম
শাস্ত্রে বলা হয়েছে-পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। কিন্তু এর ব্যাখ্যাটিকে কখনোই এভাবে উপস্থাপিত করা সংগত নয় যে শুধু পুত্র উৎপাদনের জন্যই ভার্যার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ পুত্রের জন্যই স্ত্রীসম্ভোগ করতে হয়। এর প্রকৃত নিহিতার্থটি হল-সংসারধর্ম যাপনের জন্য এবং সেই সংসার সঞ্চরণের জন্য ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি স্বরূপ সন্তানদের জন্যই স্ত্রীসম্ভোগ করা উচিত। এরূপ ক্ষেত্রে তাই শুধু পশুবৃত্তিসুলভ কামের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখানে যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হল বুদ্ধিসঞ্জাত সংসারধর্মের বিষয়। এরূপ বুদ্ধিসঞ্জাত সংসারধর্মও আমাদের ভারতীয় নৈতিকতার একটি উজ্জ্বল স্তম্ভ। ভারতের নৈতিকতা হল সংযত বুদ্ধিদীপ্ত কামাচরণের মধ্য দিয়ে মানুষের পশুসত্তাকে পরিহার করে, দেবসত্তাকে জাগরিত করা এবং মানুষকে মোক্ষাভিমুখীরূপে গড়ে তোলা।
কর্মচেতনায় কাম
কামকে বর্জন করাও কিন্তু একেবারেই সুখকর নয়। কারণ, ভোগ থেকেই আসে ত্যাগের প্রবৃত্তি। বিকৃত কাম মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত সংযত কাম মানুষকে ভোগের মাধ্যমে ত্যাগের ব্রতে ব্রতী করে তোলে। এরকম উদাহরণ আমরা আমাদের ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রে অনেক পেয়ে থাকি। যেমন রাজা জনক যিনি রাজ্যভোগের মধ্যে থেকেও ত্যাগের পথ বেছে নিয়েছিলেন। উপনিষদে কামকে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার বিষয়রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এরূপ কাম থেকে আসে সংকল্প এবং সংকল্প থেকে জাগরিত হয় কর্মচেতনা। কর্মচোদনা যদি সংকল্পের মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিত হয়, তবে তা হবে নৈতিকতাসম্পন্ন এবং এরূপ কাম-ই আমাদের কাম্যবস্তু তথা পুরুষার্থরূপে গণ্য।