ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ

ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে গভীর হতাশা এবং ঘোরতর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যা ইতালির প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিমূলে প্রবল আঘাত হানে।

    ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ

     

    ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ
    ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ

    ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণ

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালি

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে গভীর হতাশা এবং ঘোরতর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যা ইতালির প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিমূলে প্রবল আঘাত হানে। 
    • যুদ্ধোত্তর ইতালিতে শোচনীয় অর্থনৈতিক দুর্দশা দেখা দেয়। কৃষি-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দেশে প্রবল খাদ্যাভাব ও মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধশেষে সেনাদল ভেঙে দিলে বেকার সমস্যা জটিলতর রূপ ধারণ করে। 
    • এই অবস্থায় রাশিয়ার বলশেভিক ভাবধারা ইতালিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেকার যুবক ও শ্রমিকরা সমাজতন্ত্রী দলে যোগদান করতে থাকে। কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়। ইতালির শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের সময় ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস প্রভৃতির দাবিতে কলকারখানায় ধর্মঘট করতে থাকে। বহু স্থানে শ্রমিকরা নিজেরাই কলকারখানা দখল করে নেয়। কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে, জমিদারদের ভূসম্পত্তি দখল করে এবং তাদের হাতে বহু জমিদার প্রাণ হারায়। ডাকঘর, রেলসহ সর্বত্র ধর্মঘট শুরু হয়। অবস্থার সুযোগ নিয়ে সমাজবিরোধীরা দেশের বিভিন্ন অংশে ব্যাপক লুঠতরাজ শুরু করে। দাঙ্গাহাঙ্গামা, লুঠতরাজ, ধর্মঘট – প্রভৃতি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়। শিল্পপতি, জমিদার ও মধ্যবিত্তশ্রেণি সমাজতন্ত্রীদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। 
    • যুদ্ধোত্তর ইতালিতে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বলেও কিছু ছিল না। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইতালিতে অন্তত ছয়টি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, কিন্তু কারও পক্ষেই ইতালির কোনো একটি সমস্যারও সমাধান করা সম্ভব হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণ শ্রদ্ধা হারায়। এককথায়, সমগ্র জাতি সেদিন সম্পূর্ণ নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হয়। জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৮৪৫ খ্রিঃ) নামে এক নেতার আবির্ভাব হয়। তিনি ও তাঁর ফ্যাসিস্ট দল ইতালিকে নববলে বলীয়ান করে নতুন পথে পরিচালিত করেন।

    মুসোলিনির প্রথম জীবন

    ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই উত্তর ইতালির এক দরিদ্র কর্মকারের গৃহে মুসোলিনির জন্ম হয়। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসী তাঁর পিতার কর্মশালায় প্রতি সন্ধ্যায় স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক নেতারা সমবেত হতেন। তাই মুসোলিনির রাজনৈতিক চেতনার প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল পিতার কর্মশালায়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সরকার তাঁকে ‘বিপজ্জনক বিপ্লবী ‘বলে চিহ্নিত করে কারারুদ্ধ করে। কারামুক্তির পর ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক দলের মুখপত্র ‘আভান্তি’ (‘প্রগতি’) পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব। গ্রহণ করে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ইতালির সর্বত্র ঘোরতর দুর্যোগ নেমে আসে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মার্চ মিলান শহরে ১১৮ জন কর্মচ্যুত সৈনিক ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তির এক সমাবেশ মুসোলিনি ‘ফ্যাসিস্ট দল’ গড়ে তোলেন। এই দলের প্রতীক ছিল ‘ফ্যাসিস্’ (Fasces) বা দড়িবাঁধা কাষ্ঠদণ্ড। প্রাচীন রোমের রাজশক্তির প্রতীক ছিল এই ‘ফ্যাসিস্’। প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রতীক গ্রহণ করেন।

    ফ্যাসিস্ট দলের ক্ষমতালাভ

    অচিরেই এর সদস্য সংখ্যা প্রভূত বৃদ্ধি পায় এবং ইতালির প্রায় ৭০টি শহরে দলের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লক্ষ। সাম্যবাদীদের চরমপন্থা ও গণতন্ত্রীদের অপদার্থতায় বীতশ্রদ্ধ ধনবান ব্যক্তি, শিল্পপতি ও সাধারণ মানুষ মুসোলিনিকে তাদের ত্রাণকর্তা মনে করে তাঁর দলকে অর্থসাহায্য করতে থাকে। ফ্যাসিস্টদের হাঙ্গামায় ওই দলগুলি একরকম বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মুসোলিনি ইতালির রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল-কে জানান যে, তিনি তাঁর ‘ব্ল‍্যাক শার্ট’ বাহিনী নিয়ে রোম নগরী অভিযান করবেন। ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সামরিক আইন জারি করে এই অভিযান বন্ধ করতে চাইলে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল সম্মত হননি। এর ফলে রোমের ফাক্টা মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে এবং রাজার আহ্বানে মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন (৩০শে অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিঃ)। এইভাবে মুসোলিনি ও তাঁর দল ক্ষমতা দখল করে।

    ফ্যাসিস্ট প্রাধান্য

    ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বিরোধী দলগুলির ওপর নানা ধরনের অত্যাচার ও দমন-পীড়ন চলতে থাকে। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ বা হত্যা করা হয়। এইভাবে সব রকম ফ্যাসিস্ট বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে যে-সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে গুন্ডামি ও কারচুপির দ্বারা ফ্যাসিবাদী দল ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে যে নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হয়, তার দ্বারা ইতালিতে অন্যান্য দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং ইতালীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসোলিনি ইল দ্যুচে’ (II Duce) বা ‘একনায়ক’ উপাধি ধারণ করেন।

    ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের পার্থক্য

    ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্র হল বিপরীতধর্মী দু’টি ভাবধারা। গণতন্ত্র উদার। এখানে জনসাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। ফ্যাসিবাদে তা হয় না- রাষ্ট্রই এখানে সব। গণতন্ত্রে ভোটাধিকার, স্বাধীন আইনসভা, বিচারব্যবস্থা থাকে। ফ্যাসিবাদে তা অনুপস্থিত। যেখানে নেতার ইচ্ছাই সব। • গণতন্ত্রে সরকারের সমালোচনা করা যায়। নেতার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করা যায়। ফ্যাসিবাদে তা হয় না। সেখানে নেতার বিরোধিতা করার অর্থই হল নির্যাতন বা মৃত্যু।

    Leave a Comment