আর্যসত্য কী? বুদ্ধদেব নির্দেশিত চারটি আর্যসত্য ব্যাখ্যা করো

আর্যসত্য কী? বুদ্ধদেব নির্দেশিত চারটি আর্যসত্য ব্যাখ্যা করো
আর্যসত্য কী? বুদ্ধদেব নির্দেশিত চারটি আর্যসত্য ব্যাখ্যা করো

আর্যসত্যের পরিচয়

বুদ্ধদেব তাঁর কঠোর তপস্যায় যে-সমস্ত সত্যকে উপলব্ধি করেছেন, সেগুলিকেই বলা হয় আর্যসত্য। কঠোর তপস্যার ফলে বুদ্ধদেব চারটি সাধনালব্ধ সত্যের উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেগুলিকেই বলা হয় আর্যসত্য চতুষ্টয় বা চারটি আর্যসত্য (চত্বারি আর্য সত্যানি)। তপস্যার ফল হিসেবে তিনি এই চারটি আর্যসত্যের উপলব্ধি লাভ করেছেন। এই চারটি আর্যসত্য হল- দুঃখ, অর্থাৎ দুঃখ আছে। দুঃখ সমুদায়, অর্থাৎ দুঃখের কারণ আছে। দুঃখ নিরোধ, অর্থাৎ দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব এবং দুঃখ নিরোধ মার্গ, অর্থাৎ দুঃখ নিবৃত্তির পথ আছে।

বুদ্ধদেব নির্দেশিত চারটি আর্যসত্যের ব্যাখ্যা

[1] প্রথম আর্যসত্য-দুঃখ আছে
এই আর্যসত্যের মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হল-জীবন ও জগৎ দুঃখময়। অর্থাৎ জগতের সবকিছুই দুঃখে পূর্ণ (সর্বম্ দুঃখম্)। বুদ্ধদেবের তপস্যার প্রথম বোধিলব্ধ সত্য এটাই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দুঃখ মানুষের চিরসাথি। জন্ম, জরা, মরণ, রোগ, শোক-এ সমস্ত কিছুই হল মানুষের দুঃখপূর্ণ অবস্থা। জগতে এমন কিছুই নেই যা আমাদের দুঃখ প্রদান করে না। জীবন ও জগতের সবকিছুই অনিত্য ও দুঃখময়।

[2] দ্বিতীয় আর্যসত্য-দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের কারণ আছে
দুঃখ সমুদয়ের অর্থ হল-জগতে যেমন দুঃখ আছে, তেমনি দুঃখের কারণও আছে। বুদ্ধদেব তাঁর সাধনায় এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন যে, আমরা বিনা কারণে দুঃখ ভোগ করি না। দুঃখের তাই কারণও বিদ্যমান। এই দ্বিতীয় আর্যসত্যটি বৌদ্ধদের প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব তথা কার্যকারণ নীতি থেকেই নিঃসৃত। এই নীতি অনুসারে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেকটি ঘটনাই তার পূর্ববর্তী ঘটনা থেকে নিঃসৃত। অর্থাৎ, পূর্ববর্তী ঘটনা তথা কারণ থেকে পরবর্তী ঘটনা তথা কার্যের আবির্ভাব হয়। বিনা কারণে তাই কোনো দুঃখেরও আবির্ভাব হয় না।

দুঃখের কারণরূপে দ্বাদশ নিদান ও ভবচক্র: দুঃখের কারণরূপে বুদ্ধদেব বারোটি নিদানের উল্লেখ করেছেন। এগুলিকেই বলা হয় দ্বাদশ নিদান। এই দ্বাদশ নিদান মানুষকে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘোরায়। এভাবেই ভব বা জগৎ আবর্তিত হয়। এজন্যই একে বলা হয় ভবচক্র।

[3] তৃতীয় আর্যসত্য-দুঃখ নিরোধ বা দুঃখের নিবৃত্তি আছে
তৃতীয় আর্যসত্যে বলা হয়েছে, দুঃখের যেমন কারণ আছে, তেমনি তার নিবৃত্তিও আছে। বুদ্ধদেবের মতে, যে-সমস্ত কারণে দুঃখের উদ্ভব হয়, সেই সমস্ত কারণকে যদি দূর করা যায়, তাহলে দুঃখের নিবৃত্তিও সম্ভব। দুঃখের এই চির নিবৃত্তিকেই নির্বাণরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাণ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল-নিভে যাওয়া বা অবলুপ্ত হওয়া। কাঠ পুড়ে গেলে যেমন আগুন নিভে যায়, তেমনি দুঃখের কারণগুলির অবলুপ্তি হলে দুঃখেরও চির অবসান ঘটে। এই নির্বাণ হল পরমসুখ, তথা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি।

[4] চতুর্থ আর্যসত্য-দুঃখ নিরোধমার্গ বা দুঃখ নিরোধের পথ আছে
জগতে যেমন দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিবৃত্তি আছে,তেমনি দুঃখ নিবৃত্তির পথ বা উপায়ও আছে। দুঃখ নিবৃত্তির পথ বা মার্গকেই বলা হয় দুঃখ নিরোধ মার্গ। বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখ নিবৃত্তির জন্য আটটি পথ বা মার্গের উল্লেখ করা হয়েছে। গুলিকেই বলা হয় অষ্টাঙ্গিক মার্গ। দুঃখ নিরোধ তথা নির্বাণ লাভের মার্গ তথা পথের এই আটটি অঙ্গ হল— সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প, সম্যক বাক, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব, সম্যক ব্যায়াম, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি।

Leave a Comment