অর্থ কীভাগে কাম্যতত্ত্বরূপে গণ্য তা আলোচনা করো

অর্থ কীভাগে কাম্যতত্ত্বরূপে গণ্য তা আলোচনা করো
অর্থ কীভাগে কাম্যতত্ত্বরূপে গণ্য তা আলোচনা করো

কাম্যতত্ত্বরূপে অর্থ

অর্থ হল চতুর্বিধ পুরুষার্থের অন্যতম একটি কাম্যবস্তু। কারণ, ধর্মের আচরণের জন্য অর্থেরও প্রয়োজন হয়। অর্থ ছাড়া ধর্মাচরণ সম্ভব নয় বলেই, অর্থকে একটি কাম্যবস্তু তথা পুরুষার্থরূপে গণ্য করা হয়েছে। অনেকে অবশ্য এই অর্থকে একটি গৌণ কাম্যবস্তুরূপে উল্লেখ করেছেন। কারণ, অর্থের কাজ হল অপরাপর পুরুষার্থলাভের পথে সহায়ক হয়ে ওঠা। কিন্তু চাণক্য অর্থকে ধর্মের মূল ভিত্তিরূপে উল্লেখ করে বলেন-ধর্মস্য মূলম্ অর্থঃ। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এরূপ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। যাইহোক-না-কেন, এ কথা ঠিক যে, অর্থের প্রয়োজন হয় জীবনের সমস্তক্ষেত্রেই। অর্থ ছাড়া জীবনপ্রবাহকে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। ধর্মাচরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। আশ্রম ধর্ম পালনের জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। বেদবিহিত বিভিন্ন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। গার্হস্থ্য জীবনযাপনের জন্যও অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থকে তাই মানবজীবনের অন্যতম একটি পুরুষার্থরূপে গণ্য করা হয়।

পুরুষার্থরূপ অর্থ ইষ্টসাধক ও অনিষ্টনাশক

এ কথা ঠিক যে, জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই অর্থের প্রয়োজন আছে। অর্থ ছাড়া মানুষের জীবনপ্রবাহকে কখনোই এক পা-ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। অর্থ – একটি অন্যতম পুরুষার্থ বা কাম্যবস্তু ঠিকই, কিন্তু যে-কোনোভাবে অর্জিত অর্থকে কাম্যবস্তু তথা পুরুষার্থের মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ, অসৎভাবে বা অন্যায়ভাবে উপার্জিত অর্থ কখনোই পুরুষার্থের মর্যাদা পেতে পারে না। পুরষার্থের মর্যাদা পেতে গেলে অর্থকে সৎ উপায়ে অর্জিত হতে হবে। পুরুষার্থরূপে অর্থকে এমনই হতে হবে যে, তা যেমন একদিকে ব্যক্তির = মঙ্গলসাধন করবে, অপরদিকে তেমনই আবার অপরের অনিষ্টসাধন না করে। পুরুষার্থরূপ অর্থ তাই একদিকে যেমন ইষ্টসাধকরূপে গণ্য, অপরদিকে তেমনই ন আবার অনিষ্টনাশকরূপেও গণ্য।

 সৎভাবে অর্জিত ও সৎপথে ব্যয়িত অর্থই কাম্যবস্তু

অর্থকে তখনই কাম্যবস্তুর মর্যাদা দেওয়া যায়, যখনই তা একদিকে যেমন সৎপথে অর্জিত হবে, অপরদিকে তেমনই তা সৎপথে ব্যয়িতও হবে। অর্থাৎ, অর্থকে সৎপথে উপার্জন করতে হবে, আবার তাকে সৎভাবে ব্যয়ও করতে হবে। অসৎভাবে উপার্জিত অর্থ যেমন কাম্যবস্তু হতে পারে না, তেমনই অসৎভাবে ব্যয়িত অর্থও কাম্যবস্তুর মর্যাদা লাভ করতে পারে না। অসৎভাবে অর্থব্যয় কখনোই ধর্মোচিত কাজ নয়। সুতরাং বলা যায় যে, ন্যায়সম্মতভাবে অর্থ উপার্জন করে যদি তা ন্যায়োচিতভাবেই ব্যয় করা হয়-তবে সেরূপ অর্থই পুরুষার্থ তথা কাম্যবস্তুরূপে গণ্য।

নৈতিকতার দৃষ্টিতে অর্থের অভাব ও প্রাচুর্যতা কোনোটিই কাম্য নয়

নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বলা যায় যে, অর্থের অভাব যেমন কাম্য নয়, তেমনই তার প্রাচুর্যতাও কাম্য নয়। অর্থের অভাব ধর্মাচরণের দিকটিকে বাধা দেয় যেমন, তেমনই আবার তার প্রাচুর্যতাও মানুষকে অসৎপথে চালিত করে। অর্থের অভাব হলে মানুষ সাধারণত অসৎ হয় এবং বিভিন্ন প্রকার অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করে। অর্থের অভাবে মানুষ যে-কোনো প্রকারে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে এবং তা সঞ্চয় করে। আবার অর্থের প্রাচুর্যতাও কখনোই কাম্য নয়। কারণ, অর্থের প্রাচুর্যতা মানুষকে অসৎ ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলে এবং নানাপ্রকার অনৈতিক কাজে প্রোৎসাহিত করে। এরূপ উভয়ক্ষেত্রেই অর্থকে পুরুষার্থরূপে গণ্য করা যায় না। সুতরাং প্রয়োজনভিত্তিক অর্থই হল পুরুষার্থরূপে গণ্য।

ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থই পুরুষার্থ

নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, সৎপথে অর্জিত অর্থের কার্পণ্যতাও যেমন কাম্য নয়, তেমনই আবার তার অতিরিক্ত ব্যয়ও কাম্য নয়। কারণ, অর্থের কার্পণ্যতা মানুষের মনুষ্যসত্তাকে সংকুচিত করে। আবার অর্থের অতিরিক্ত ব্যয়ও তার সত্তাকে উচ্ছৃঙ্খল বা এলোমেলো করে তোলে। সে কারণেই বলা যায় যে, অর্থের উপার্জন এবং ব্যায়ের ক্ষেত্রে সংযত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। অর্থের ক্ষেত্রে সংযত নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের নিয়ন্ত্রণ একান্তভাবেই কাম্য। কারণ, একমাত্র ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণই অর্থের সদ্ব্যবহারে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং বলা যায় যে, ধর্মের দ্বারা যখন অর্থ নিয়ন্ত্রিত হয়, একমাত্র তখনই তা পুরুষার্থরূপে গণ্য হয়। এরূপ অর্থই মানুষকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

Leave a Comment