অনৈতিক ক্রিয়া কোনগুলি তা সংক্ষেপে আলোচনা করো

অনৈতিক ক্রিয়া কোনগুলি তা সংক্ষেপে আলোচনা করো

অনৈতিক ক্রিয়া কোনগুলি তা সংক্ষেপে আলোচনা করো
অনৈতিক ক্রিয়া কোনগুলি তা সংক্ষেপে আলোচনা করো

অনৈতিক ক্রিয়া

মানুষের মধ্যে ঐচ্ছিক ক্রিয়া ছাড়াও কিছু ক্রিয়া দেখা যায়- যেগুলি তার ইচ্ছার দ্বারা সম্পাদিত না হয়ে অনিচ্ছার দ্বারা সম্পাদিত হয়। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকেই বলা হয় অনৈচ্ছিক ক্রিয়া (Nonvoluntary Action)। এই ধরনের ক্রিয়াগুলির নৈতিক বিচার আদৌ সম্ভব নয় বলেই এগুলিকে বলা হয় অনৈতিক বা নীতিবহির্ভূত ক্রিয়া (Nonmoral Actions)। অর্থাৎ, এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি নৈতিক মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, তীব্র গন্ধে হাঁচি পাওয়া, ভাবের ঘোরে চোখ থেকে জল পড়া, দীর্ঘ বিরহের পর মিলনে কেঁদে ওঠা, প্রভৃতি অনৈচ্ছিক ক্রিয়ারূপে গণ্য। এই ধরনের ক্রিয়াগুলির নৈতিক বিচার সম্ভব নয় বলেই এগুলিকে বলা হয় অনৈতিক ক্রিয়া। নীতিবিজ্ঞানে অনৈচ্ছিক ও অনৈতিক ক্রিয়ারূপে যে-সমস্ত ক্রিয়াগুলির উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি হল-

[1] স্বভাবজাত বা স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া (Spontaneous Actions or Random Actions)

জন্ম থেকেই মানুষ যে-সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করার ক্ষমতা বা কৌশল লাভ করে, সেগুলিকেই বলা হয় স্বভাবজাত বা স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়া। এই সমস্ত ক্রিয়াগুলিকে সম্পাদন করার জন্য কোনো শিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। স্বভাবজাতভাবেই এগুলিকে মানুষ সম্পাদন করতে পারে। মানুষের মধ্যে এগুলি স্বতঃভাবেই ক্রিয়াশীল বলে এগুলিকে স্বয়ংক্রিয় বা স্বতঃসঞ্জাত ক্রিয়া বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, রক্তসঞ্চলন ক্রিয়া, নবজাতকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রিয়া, আনন্দে উল্লসিত হওয়ার ক্রিয়া, দুঃখে বিমর্ষিত হওয়ার ক্রিয়া, প্রভৃতি হল স্বভাবজাত বা সয়ংক্রিয় ক্রিয়া। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে ভাবনাচিন্তা করে সম্পন্ন করতে হয় না। এগুলি স্বাভাবিকভাবেই সম্পাদিত হয়। সেকারণেই এগুলিকে ভালো-মন্দ, ন্যায়- অন্যায়ের মাপকাঠিতে বিচার করা সম্ভব নয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে অনৈচ্ছিক ক্রিয়া এবং অনৈতিক ক্রিয়ারূপে গণ্য করা হয়।

[2] সাহজিক বা প্রবৃত্তিগত ক্রিয়া (Instinctive Actions)

পূর্বলম্ব শিক্ষণ অথবা সংকল্পের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে, ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্বন্ধে সচেতন না হয়ে, নিজের জৈবিক পরিতৃপ্তিসাধনের জন্য অথবা আত্মরক্ষার জন্য যে-সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন করা হয়, সেগুলিকেই বলা হয় সাহজিক বা প্রবৃত্তিগত ক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, খাদ্য অন্বেষণ করা, খাদ্য গ্রহণ করা, যৌন আবেদনে সাড়া দেওয়া, সন্তান পালন করা, শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা প্রভৃতি হল মানুষের সাহজিক বা প্রবৃত্তিগত ক্রিয়া। এই ধরনের ক্রিয়াগুলির জন্য মানুষ নিজে কখনোই দায়ী থাকে না এবং সেকারণেই এই ধরনের ক্রিয়াগুলির নৈতিক বিচার সম্ভব নয়। এগুলিকে তাই নৈতিকতার মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। সেকারণেই এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে অনৈতিক ক্রিয়ারূপে গণ্য করা হয়।

[3] প্রতিবর্ত ক্রিয়া (Reflex Actions)

স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ ছাড়াই শুধুমাত্র বাহ্য উদ্দীপকের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে যে-সমস্ত প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়, সেগুলিকেই বলা হয় প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলি কখনোই বিচারবুদ্ধিপ্রসূত নয়। এগুলিকে তাই সচেতন মনের ক্রিয়ারূপে গণ্য করা যায় না। আবার এগুলি সচেতনভাবে পূর্বপরিকল্পিতও নয় ও স্বাধীনভাবে কৃতও নয়। এগুলি আকস্মিকভাবেই সম্পাদিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, তীব্র গন্ধে হাঁচি হওয়া, বজ্রপাতে চমকে ওঠা, ভয় পেয়ে চিৎকার করা, তীব্র আলোকে চোখ বোজা, হঠাৎ ধমকে থতমত খাওয়া, প্রভৃতি হল প্রতিবর্ত ক্রিয়া। এই ধরনের ক্রিয়াগুলি কখনোই স্বাধীন ও সচেতনভাবে সম্পন্ন নয় বলে, এগুলির ভালো-মন্দ নির্ধারণ করা যায় না। অর্থাৎ, এগুলির নৈতিক বিচার আদৌ সম্ভব নয়। এই ধরনের অনৈচ্ছিক ক্রিয়াগুলিকে তাই অনৈতিক ক্রিয়ারূপেই গণ্য করা যায়।

[4] ভাবজ ক্রিয়া (Ideo-motor Acitons)

মনের ভাব বা ধারণা যখন অত্যন্ত তীব্র হয়ে নিজে নিজেই বা স্বতঃভাবেই ক্রিয়ায় পরিণত হয়, তখন তাকেই বলা হয় ভাবজ ক্রিয়া। এই ধরনের ক্রিয়া সম্পাদনে কোনো প্রচেষ্ঠার প্রয়োজন হয় না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, নাটকের কোনো চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে তার সুখে বা আনন্দে হেসে ওঠা, দুঃখে কেঁদে ওঠা, আবার ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে ফুটবল খেলার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ভাব তন্ময়ে পাশের লোকটিকে ফুটবল ভেবে লাথি মারা, কোনো সুর শুনে অঙ্গ সঞ্চালন করা, প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম দেখে পাশের লোকটিকে জড়িয়ে ধরা- প্রভৃতি হল ভাবজ ক্রিয়ার প্রতিফলন। এই সমস্ত ক্রিয়াগুলি কখনোই সচেতন মনের প্রতিফলন নয়। ভাবে তন্ময় হয়েই এই ধরনের ক্রিয়াগুলি সম্পাদিত হয়। এগুলি তাই ঐচ্ছিক ক্রিয়ারূপে গণ্য না হয়ে, অনৈচ্ছিক ক্রিয়ারূপেই গণ্য। এই ধরনের ক্রিয়াগুলির ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করা সম্ভব নয় বলেই এগুলিকে বলা হয় অনৈতিক ক্রিয়া।

[5] অনুকরণ লব্ধ ক্রিয়া (Imitative Actions)

অনেকসময় দেখা যায় যে আমাদের অনেক ক্রিয়াই অন্য কোনো বাক্তির ক্রিয়াকে অনুসরণ করে সম্পাদিত হয়। অন্য ব্যক্তিদের ক্রিয়াকে অনুসরণ করে যে-সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, সেগুলিকেই বলা হয় অনুকরণলব্ধ ক্রিয়া (Imitative Actions)। এই ধরনের অনুকরণলব্ধ ক্রিয়া পরিণত ব্যক্তিদের অপেক্ষা অধিক পরিমাণে শিশুদের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। কারণ, শিশুরা বহুলপরিমাণে অনুকরণপ্রিয়। অর্থাৎ যাদের ক্রিয়াগুলি তাদের পছন্দের, সেই সমস্ত ক্রিয়াগুলিকেই তারা অনুকরণ করতে চায়। অনুকরণলব্ধ ক্রিয়াকে আবার ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিকরূপেও উল্লেখ করা যায়। যে-সমস্ত অনুকরণলব্ধ ক্রিয়া ঐচ্ছিকভাবে সম্পাদিত হয়, তাদের নৈতিক বিচার সম্ভব হলেও হতে পারে। কিন্তু যে-সমস্ত ক্রিয়া অনৈচ্ছিকরূপে গণ্য, সেই সমস্ত ক্রিয়ার নৈতিক বিচার আদৌ সম্ভব নয়। সেকারণেই অনৈচ্ছিক অনুকরণলব্ধ ক্রিয়াগুলিকে অনৈতিক ক্রিয়ারূপে গণ্য করা হয়।

[6] উন্মাদ ব্যক্তির ক্রিয়া (Actions of Insane Persons)

উন্মাদ বা অস্বাভাবিক ব্যক্তিদের ক্রিয়াকলাপ কখনোই সচেতন ও ঐচ্ছিকভাবে সম্পন্ন নয়। কারণ, এই ধরনের ব্যক্তিদের ক্রিয়াকলাপের মধ্যে কোনোরকম সচেতন পূর্বকল্পনা থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই এরা এদের চেতনাসম্পন্ন বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এর ফলে এরা কখনোই একজন স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় আচরণ করতে পারে না। সংগত কারণেই এদের ক্রিয়াকলাপ অস্বাভাবিকরূপে গণ্য হয়। এই ধরনের অস্বাভাবিক ক্রিয়াগুলিকে তাই কখনোই নৈতিকভাবে বিচার করা যায় না। উন্মাদ ব্যক্তিদের ক্রিয়াকলাপকে তাই অনৈচ্ছিক ও অনৈতিকরূপে গণ্য করা হয়।

[7] আকস্মিক ক্রিয়া (Accidental Actions)

মানুষের কিছু কিছু ক্রিয়াকলাপ আবার আকস্মিকভাবে সম্পাদিত। এই ধরনের ক্রিয়াগুলি হঠাৎই কোনো কারণ ছাড়াই সংঘটিত হয়। এই ধরনের ক্রিয়াগুলির পিছনে তাই কোনো সচেতন উদ্দেশ্য থাকে না এবং সেকারণেই এগুলিকে কখনোই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা আগে থেকেই উপায় ও উদ্দেশ্য স্থির করে ক্রিয়াগুলিকে স্বাধীন ও ইচ্ছাকৃতভাবে সম্পাদন করি। কিন্তু আকস্মিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এরূপ লক্ষণগুলি দেখা যায় না। সেকারণেই আকস্মিক ক্রিয়াগুলি কখনোই ঐচ্ছিক ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আর সেকারণেই এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে ভালো-মন্দের নিরিখে বিচার করা যায় না। অর্থাৎ, এগুলির নৈতিক বিচার সম্ভব নয়। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে তাই অনৈতিকরূপেই গণ্য করা হয়।

[৪] শিশু ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির ক্রিয়া (Actions of Infants and Idiots)

এ কথা ঠিক যে, শিশু এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্রিয়াকলাপ কখনোই সচেতনভাবে মনের বহিঃপ্রকাশ নয়। এদের ক্রিয়াকলাপগুলি তাই স্বাধীন ও ঐচ্ছিকভাবে কৃত নয়। স্বাভাবিকভাবে তাই উল্লেখ করা যায় যে, এই ধরনের ক্রিয়াগুলির ক্ষেত্রে সচেতন বিচারশক্তির অভাব দেখা যায়। এদের ক্রিয়াকলাপগুলিকে তাই ন্যায়-অন্যায়ের নিরিখে বিচার করা যায় না। এই ধরনের ক্রিয়াগুলিকে তাই অনৈতিক ক্রিয়ারূপে গণ্য করা হয়।

Leave a Comment