স্মরণে ও মননে অটলবিহারী বাজপেয়ী রচনা
স্মরণে ও মননে অটলবিহারী বাজপেয়ী (১৯২৪-২০১৮) রচনা |
ভূমিকা
অনন্যসাধারণ রাজনীতিবিদ ও দক্ষ প্রশাসক অটলবিহারী বাজপেয়ী জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৬ আগস্ট, ২০১৮ বৃহস্পতিবারের বারবেলা বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে। রেখে গেলেন তাঁর পরমত সহিষ্কৃতাকে, মনুষ্যত্ববোধকে ও রাজনৈতিক পরিমিতিবোধকে, পথ দেখিয়ে গেলেন একুশ শতকের আধুনিক ভারতের। রাজনীতির জগৎ থেকে প্রস্থান ঘটেছিল অনেক আগেই, পার্থিব জগৎ থেকেও তিনি চলে গেলেন নিঃশব্দে।
জন্ম ও শিক্ষা
কৃষ্ণা দেবী ও কৃত্ববিহারী বাজপেয়ীর সন্তান অটলবিহারীর জন্ম ১৯২৪-এর ২৫ ডিসেম্বর, গোয়ালিয়রে। তাঁর বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তাঁর বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়েছিল গোয়ালিয়র-এর সরস্বতী শিশু মন্দির স্কুলে। এরপর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনটি বিষয়ে ডিস্টিংশান সহ স্নাতক হন ও কানপুর-এর ডাভ কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন। গোয়ালিয়রে তিনি আর্য কুমার সভা স্থাপন করেন ও পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগ দেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি সামিল হয়েছিলেন। ১৯৫১-তে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় জনসঙ্ঘে যোগ দেন ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিব হন।
রাজনৈতিক মতাদর্শ
তিনি বরাবরই রাজনীতিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং বিরোধী রাজনীতিকদের কথা শুনতেন ও তাঁদের গুরুত্ব দিতেন। মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যেমন তাঁর ছিল না তেমনি উদারনৈতিক ভাবনায় ভাবিত বলেই তিনি তাঁর প্রশাসনকে আর এস এস-এর গণ্ডী থেকে বের করে এনে স্বাধীন সত্তায় অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। কোনোরকম সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতা তাঁকে গ্রাস করেনি। তাই ১৯৮৪-তে লোকসভায় মাত্র ২টি আসন নিয়ে যে দলের পদযাত্রা তা ১৯৯৬-তে ১৬২-তে পৌঁছে গিয়েছিল-তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে। ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির জন্য তিনি রামমন্দির আন্দোলন থেকে সরে এসেছেন, গোধরা কান্ডের নিন্দা করেছেন, ওড়িশায় গ্রাহাম স্টেন হত্যায় দোষীকে শাস্তি দিয়েছেন।
রাজনৈতিক কর্মকান্ড
১৯৫৭ সালে লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের বলরামপুর থেকে বিজয়ী হয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় তিনি জেলও খেটেছিলেন। ১৯৭৭-এ ভারতীয় জনসঙ্ঘকে জনতা পার্টির সঙ্গে মিশিয়ে দেন তিনি। এই সময় তিনি বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। ১৯৮০-তে তিনি ভারতীয় জনতা পার্টি গঠন করেন। ১৯৯৬-তে ১৬২টি আসন জয় করে একক বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন এবং মাত্র ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর ১৯১৮-তে আবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৩ মাস দেশ শাসন করেন ও ১৯৯৯-তে পুনরায় জয়লাভ করে পুরো সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। ২০০০ সালে ২১শে মার্চ ভারত মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ককে মজবুত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী
তাঁর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীত্বের উল্লেখযোগ্য কাজ হল পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণ-যা | ২৪ বছর পর সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাতে আমেরিকা, কানাডা, জাপান ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও বাজপেয়ী দৃঢ় থাকেন। আবার ১৯৯৮-তে লাহোর শান্তি বৈঠক ভারত-পাক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে ও পাকিস্তান ঘোষণা করে তাদের দেশের মাটিতে ভারত বিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাবার অনুমতি দেওয়া হবে না। কারগিল সংঘর্ষ (১৯৯৯) ও তাঁর সময়কার ঘটনা-যেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপে পাকসেনা পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল।
কারগিলের ঘটনার পরও বাজপেয়ী পাকিস্তানের সঙ্গে আগ্রা শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছেন। কান্দাহার ছিনতাই-র মতো ঘটনাকে মেনে নিয়েছিলেন ও মাসুদ আজাহার-এর মতো জঙ্গীকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ১৭৬ জন ভারতীয় বিমানযাত্রীকে বাঁচাবার জন্য। ২০০১-এ সংসদ আক্রমণ ও পাঁচ লাখ সেনাকে সীমান্তে মোতায়েনও তাঁর সময়কার ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ হল স্বর্ণ চতুর্ভুজ বা দেশে উন্নতমানের সড়কজাল বিস্তার-যা কলকাতা, বোম্বাই, চেন্নাই ও দিল্লিকে সড়কপথে জুড়ে দিয়েছে। মোট ৫৮৪৬ কিমি. রাস্তা নির্মাণ-যা ভারতের বৃহত্তম সড়ক প্রকল্প।
সাহিত্যিক
অটলবিহারী বহিরঙ্গে রাজনৈতিক হলেও অন্তরঙ্গে কবি। তাঁর বাগ্মিতা, কবিতা তথা ছন্দের জাদু সংসদের বাইরে-ভিতরে সমানভাবে সমাদৃত। জেলে বসেও তাঁর সৃষ্টিধর্মিতাকে বিস্তৃত করে দিয়েছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্ধকার সময়ে লিখেছেন, ‘আও ফির সে দিয়া জ্বালায়ে’। আপোষহীন রাজনৈতিক হিসেবে লিখেছেন, ‘দাঁও পর সব কুছ লাগা হ্যায়, বুক নেহি সকতে। টুট সকতে হ্যায় মগর, হম ঝুঁক নেহি সকতে’। তিনি মাসিক পত্রিকা ‘রাষ্ট্র-ধর্ম’, হিন্দি সাপ্তাহিক ‘পাঞ্চজন্য’, দৈনিক পত্রিকা ‘স্বদেশ’, ‘বীর অর্জুন’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কারগিল যুদ্ধে ভারতের জয়ের পর বাজপেয়ীই পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারী দিয়ে লিখতে পেরেছিলেন, ‘আপনে হি হাতো তুম আপনি কবর না খোঁড়ো, আপনে পায়রো আপ কুলহারি নেহি চলাও/ও নাদান পড়োসি আপনি আঁখে খোলো, আজাদি আনমোল না ইসকা মোল লাগাও।’
উপসংহার
১৯৯২-তে পদ্মবিভূষণ ও ২০১৫-তে তিনি ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন, শেষ নজীবনে বাকরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। ২০১৮ সালের ১১ই জুন কিডনিতে সংক্রমণ নিয়ে দিল্লির এইমসে ভর্তি হয়ে তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুতে আপামর ভারতবাসীর মতো বহু রাজনীতিকও স্মৃতিভারে ভারাক্রান্ত। এর কারণ তাঁর বহুমুখী প্রতিভা তথা বিরল মনুষ্যত্ববোধ, পরমতসহিষ্কৃতা ও ভারতীয় সংস্কৃতির ৩ প্রতি আস্থা। তাঁর মৃত্যু শ্রেণি, মত, ধর্ম ও রাজনীতি নির্বিশেষে বহু মানুষকে একত্র সমন্বিত শ করে দিতে পেরেছে-যা বর্তমান দিনে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন – সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা