সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা 500+ শব্দে

সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা

সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা
সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী রচনা

ভূমিকা

ইতিহাসবোধ ও ভারতীয় চেতনার নিপুণ মিতবাক অন্তর্মুখী শিল্পী রমাপদ চৌধুরী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও স্বাধীনতা উত্তরকালের কথাসাহিত্যে এক স্বতন্ত্র ব্যস্তিত্ব-যাঁর সাম্প্রতিক মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে প্রায় চারদশক ধরে উপন্যাস, গল্প, কিশোর সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্যে শুধু সমকালীন জীবনের সংকটের ছবি নেই, সেই সন্ধ্যে রয়েছে অস্তিত্বের সংকট কীভাবে মানুষকে আন্দোলিত করে, তার বাস্তব ছবি। এর কারণ তাঁর দৃষ্টি ছিল ব্যক্তি ও সমাজের গভীর মর্মমূলে।

বাল্যশিক্ষা

১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে রমাপদ চৌধুরীর জন্ম। বাল্যশিক্ষা তাঁর খল্যপুরে। এরপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়, গল্পের নাম ‘ট্র্যাজেডি’। গল্পটি প্রকাশিত হয় ‘আজকাল’ সাপ্তাহিক পত্রিকায়। এরপর রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বারো ঘোড়ার আস্তাবল’।

রচনা সমূহ

তাঁর রচিত উপন্যাসগুলি হল: ‘প্রথম প্রহর’, ‘অরণ্য আদিম’, ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘লালবাঈ’, ‘পরাজিত সম্রাট’, ‘এখনই’, ‘পিকনিক’, ‘খারিজ’, ‘বাড়ি বদলে যায়’, ‘আশ্রয়’, ‘রাজস্ব’, ‘মানুষের সংসার’, ‘শেষের সীমানা’, ‘জনৈক নায়কের জন্মান্তর’ ইত্যাদি। অন্যদিকে তাঁর প্রকাশিত গল্প সংকলনগুলি হ’ল: ‘তিনতারা’, ‘স্বর্ণমারীচ’, ‘অভিসার রানটী’, ‘দরবারী’, ‘পিয়াপসন্দ’, ‘আপন প্রিয়’, ‘কখনো আসেনি’, ‘কথাকলি’, ‘চন্দন কুক্কুম’, ‘দেহলী দিগন্ত’, ‘যদিও সন্ধ্যা’, ‘সুখের পায়রা’, ‘বুমাবাঈ’, ‘লজ্জাবতী’, ‘আমরা সবাই একসঙ্গে’, ‘পোস্ট মর্টেম’ ইত্যাদি।

ঔপন্যাসিক সত্তা

তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘প্রথম প্রহর’-এ রয়েছে লেখকের আত্ম-আবিষ্কারের কাহিনি। লেখকের বীক্ষণ, বিষয় ও শৈলী উচ্চমানের। রেল কলোনির সমাজ উঠে এসেছে উপন্যাসে। ‘দ্বীপের নাম টিয়ারঙ’ উপন্যাসে চিত্রিত কর্মচ্যুত দ্বীপের মানুষের জীবনকে নতুন করে গড়ে তোলার কথা। বাংলার গ্রাম তথা পল্লীজীবনের বিবর্তনের পটভূমিতে রচিত ‘বনপলাশির পদাবলী’। স্বাধীনতার দশ বছর পরের বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের অন্তর্গত বনপলাশি গ্রাম ও সেই সময়ের গ্রাম সমাজের বিবর্তনকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে লেখক চিত্রিত করেছেন। ‘লালবাঈ’ উপন্যাসে প্রাচীন সঙ্গীতের পীঠস্থান বিষ্ণুপুর ও তার অতীত ইতিহাস এবং সেই পটভূমিতে যুবতী লালবাঈ-র সঙ্গীত সাধনা ও তার যন্ত্রণার ছবি অঙ্কন করেছেন লেখক। ‘বাড়ি বদলে যায়’ উপন্যাসে রয়েছে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্ক এবং সেই সূত্রে সূক্ষ্ম দার্শনিকতার উন্মোচন। আবার ‘আশ্রয়’ উপন্যাসে রয়েছে মধ্যবিত্ত মানসিকতার ছবি।

গল্পাকার সত্তা

গল্পকার হিসেবে রমাপদ চৌধুরী একজন নিষ্ঠাবান লেখক। তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুর যেমন বৈচিত্রা ও গভীরতা আছে তেমনি গল্পের সমাপ্তিতে আছে ‘অনন্ত সিন্ধু’-র স্বাদ। তাঁর প্রথম দিককার গল্পগুলিতে বিষয় হিসেবে এসেছে আদিবাসী জীবন-তাঁর কর্মস্থল রাঁচির বনাঞ্চল সমৃদ্ধ কোলিয়ারী অঞ্চল। যেমন, ‘রেবেকা সোরেনের কবর’ গল্পটি এক আদিবাসী মেয়ের একনিষ্ঠ প্রেমের গল্প। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশবিভাগ, দেশের রাজনৈতিক অবস্থার , হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তাঁর গল্পে শিল্পসার্থকতা লাভ করেছে। যেমন, ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি-যা একটি স্বাধীন ভারতের দলিল। বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে গ্রামের মানুষদের নিষ্কর্মা, অলস ভিক্ষুকে পরিণত করে দিয়ে গেল তার বাস্তব কাহিনি এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে। দেশবিভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর-এর পটভূমিতে রচিত তাঁর গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘অাপালী’, ‘করুণ কন্যা’ ইত্যাদি।

আবার মধ্যবিত্তের বিওহীনতা, অসহায়তা, ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, অহেতুক বীরত্বের আস্ফালন, মেকি সেন্টিমেন্ট প্রভৃতি উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়েছে তাঁর গল্পে। এই ধরনের গল্প হল ‘আমি, আমার স্বামী ও একটি নুলিয়া’। এমনকি কল্পনা ও বাস্তব কীভাবে হাত ধরাধরি করে রমাপদ চৌধুরীর গল্পে অবস্থান করতে পারে, তার নিদর্শন হল ‘ঝিনুকের কৌটো’। উদ্ভাবন নৈপুণ্যে, উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্যে, ভাষার সাবলীলতায়, টেকনিকের অভিনবত্বে ও উত্তর আধুনিকতার সন্ধানে রমাপদ চৌধুরীর গল্পের ব্যঞ্জনা অন্তরের স্বাদ বয়ে নিয়ে আসে।

উপসংহার

শিল্পী হিসেবে রমাপদ চৌধুরীর জীবনদর্শন ছিল উন্নত মানের, অভিজ্ঞতা ছিল প্রচুর। আর তাকেই মূলধন করে তিনি সমকালকে এঁকেছেন সমসাময়িক লেখকদের থেকে পৃথকভাবে একেবারে সমাজের গভীর ও সূক্ষ্ম দিকটাকে। ফলে তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠেছে শাশ্বত জীবনসত্যে তীক্ষ্ণ ও গভীর। জীবনকে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে অঙ্কনের সেই প্রচেষ্টা তাঁকে যেমন অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে তেমনি তারাশঙ্কর ও সুবোধ ঘোষের অনুসারী আর একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর জাতটিকে পাঠকের কাছে স্পষ্ট করে দিয়ে।

আর পড়ুন – নীতি-কর্তব্যবাদীরূপে কান্টের অভিমত ব্যাখ্যা করো

Leave a Comment