সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলণ – আজকের পর্বে সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল তা আলোচনা করা হল।
সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল
সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল? |
ভূমিকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পৃথিবীতে প্রথম সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণগুলিকে মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে, যথা: সুদূরপ্রসারী ও তাৎক্ষণিক। সুদূরপ্রসারী কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-ইউরোপ মহাদেশের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী সংঘাত এবং ইউরোপের বাইরে ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
[১] ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
ইউরোপের উগ্র জাতীয়তাবোধ বাস্তবে প্রকাশ পেয়েছিল বহির্দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে। বিশ্বের অন্যান্য জাতিগুলিকে পদানত করা এবং তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ খুঁজে পায়।
[২] বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা
একমাত্র বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় গৌরব বৃদ্ধি এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার সম্ভব বলে বিবেচিত হয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রগুলি সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই প্রাধান্য অনেকটা সুনিশ্চিত করেছিল। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইটালি এক্ষেত্রে একটু দেরিতে যাত্রা শুরু করে বলে প্রথমোক্ত রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে স্বভাবতই তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয় এবং যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
[৩] বাজার ও কাঁচামাল দখলের জন্য সংঘাত
শিল্পবিপ্লবের দ্রুত প্রসারের ফলে একদিকে যেমন প্রত্যেক দেশে শিল্পোৎপাদিত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, এর পাশাপাশি এলাকাগুলির কাঁচামালের চাহিদাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুতরাং শিল্পোৎপাদিত দ্রব্য বিক্রয়ের বাজার ও কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে সংঘাত দেখা দেয় এবং এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিতে সম্প্রসারণের নগ্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সৃষ্টি হয়।
[৪] জার্মানির সাম্রাজ্য বিস্তার প্রচেষ্টা
বিশ শতকের পূর্বেই বিশ্বে সাম্রাজ্য বিস্তারের উপযুক্ত এলাকাগুলির বেশির ভাগই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ার দখলে আসে। জার্মানি একটু দেরিতে সাম্রাজ্য বিস্তারের তাগিদ অনুভব করে, জার্মানির শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে সাম্রাজ্য বিস্তার কর্মসূচি শুরু করে আর সাধারণ মানুষ এর মাধ্যমে জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির উন্মাদনায় মেতে ওঠে।
[৫] ইঙ্গ-জার্মান সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব
সাম্রাজ্য বিস্তারের অতৃপ্তি পূরণের জন্য জার্মানি যুদ্ধকেই একমাত্র অস্ত্র হিসেবে দেখতে থাকে এবং স্থল ও নৌবাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে চলে। জার্মানির এই আগ্রাসী যুদ্ধ-নীতিতে ব্রিটেনের আশঙ্কা হয়, জার্মানির আসল মতলব হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলিকে গ্রাস করা। নৌশক্তিতে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের সেরা শক্তি। জার্মানি ছিল মূলত স্থল শক্তি। তাই ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার জন্য নৌশক্তি বৃদ্ধির বিপুল আয়োজন করে।
[৬] সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আন্তর্জাতিক সংকট
সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-মিশরকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড-ফ্রান্স বিরোধ, বল্কান অঞ্চল নিয়ে জার্মানি-রাশিয়া বিরোধ, পারস্যকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড-রাশিয়া বিরোধ, মরক্কোকে কেন্দ্র করে রাশিয়া-জার্মানি বিরোধ এবং চিনকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স-জার্মানি বিরোধ। এই বিবাদগুলি রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইউরোপকে দুটি পরস্পর বিবদমান শিবিরে (ত্রিশক্তি চুক্তি ও ত্রিশক্তি মৈত্রী) বিভক্ত করেছিল।
[৭] অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব
বার্লিনের সন্ধি অস্বীকার করে অস্ট্রিয়া, বসনিয়া ও হারজেগোভিনা দখল করায় সার্বিয়া ক্ষুব্ধ হয়, কারণ এই দুটি অঞ্চলেই সার্ব জাতির – লোক বসবাস করত। এই কারণে অস্ট্রিয়া-সার্বিয়া বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এরই পরিণতি ছিল সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড।
মূল্যায়ন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ইউরোপীয় প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলির সাম্রাজ্য বিস্তারের লিপ্সা এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে প্রাধান্য-প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাই সমগ্র বিশ্বকে একটি মহাযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দেয়। লেনিন যথার্থই বলেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতার চরম পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।