সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। ভারতের শিক্ষাসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান মূল্যায়ন করো। |
সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো। ভারতের শিক্ষাসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান মূল্যায়ন করো। |
সমাজসংস্কারক হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান
রাজা রামমোহন রায় ঊনবিংশ শতকে ভারতের ধর্ম ও সমাজকে কুসংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে ভারতবাসীকে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন। তাঁর সমাজসংস্কারমূলক কর্মসূচিগুলি হল-
(ক) জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা
রামমোহন রায় জাতিভেদ প্রথার প্রবল বিরোধী ছিলেন। তিনি অসবর্ণ বিবাহকে সমর্থন করেছিলেন এবং সমস্ত ধর্মের মানুষের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন।
(খ) নারীজাতির উন্নতির চেষ্টা
তিনি অনুভব করেছিলেন, নারীদের। অবস্থার উন্নতি এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করতে না পারলে সমাজের অগ্রগতি ঘটবে না। তিনি শাস্ত্রকারদের (যাজ্ঞবন্ধ্য, কাত্যায়ন) শাস্ত্রীয় বিধান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, পিতার সম্পত্তিতে নারীদের ন্যায্য অধিকার আছে।
(গ) সতীদাহপ্রথার অবসান
হিন্দুসমাজে প্রচলিত মর্মান্তিক সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য রামমোহন রায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বড়োলাট বেন্টিঙ্কের কাছে একটি আবেদনপত্র জমা দেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ করেন। সমাজসংস্কারক হিসেবে এটি ছিল রামমোহনের জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য।
(ঘ) অন্যান্য কুসংস্কারের বিরোধিতা
রামমোহন রায় বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কন্যাপণ, কৌলীন্য প্রথা প্রভৃতির বিরোধিতা করে সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সমাচার দর্পণ, সম্বাদ কৌমুদী, বেঙ্গল হরকরা প্রভৃতি পুস্তিকা ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার চালান তিনি।
(ঙ) সংস্কারকামী প্রতিষ্ঠান
একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী রামমোহন তাঁর বহুবিধ সংস্কারকার্যের জন্য ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা স্থাপন করেন, যা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসমাজ নামে পরিচিতি লাভ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব এই সংগঠনে যোগদান করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের সদস্যরা মূলত পৌত্তলিকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতিভেদ প্রথা এবং সর্বোপরি সতীদাহপ্রথার ন্যায় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষাসংস্কার
রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবাসীকে অন্ধকারময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন থেকে আলোয় ফেরাতে পারে একমাত্র যুক্তিনির্ভর পাশ্চাত্য শিক্ষা। তিনি প্রাচ্যের মহান চিন্তাধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে সমন্বয়বাদী-ও বলা হয়ে থাকে।
(ক) পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে গৃহীত পদক্ষেপ
রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্ট-কে একটি পত্র দিয়েছিলেন। এই পত্রে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সরকারি অর্থব্যয়ের জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ জানান।
(খ) বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন
(গ) বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা
বাংলা গদ্যসাহিত্যে রামমোহন রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার (১৮১৭ খ্রি.), ব্রাহ্মণ সেবধি (১৮২১ খ্রি.), ব্রজ্রসূচী (১৮২৭ খ্রি.) ইত্যাদি। তিনি ঈশ, কঠ, কেন, মাণ্ডুক্য, মণ্ডুক প্রভৃতি উপনিষদ বাংলায় রচনা করেন। তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে সংস্কৃত প্রভাবমুক্ত আধুনিক ব্যাকরণ শিক্ষার গ্রন্থও রচনা করেন।
(ঘ) সংবাদপত্র প্রকাশনা
ফারসি, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ভাষায় রামমোহন রায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সম্বাদ কৌমুদী (১৮২১ খ্রি.) এবং ফারসিতে প্রকাশিত মিরাৎ-উল-আখবর (১৮২২ খ্রি.)।
রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় যুক্তিবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে নবভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তাঁকে আধুনিক ভারতের জনক, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত করা হয়।
আরও পড়ুন – স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকা আলোচনা করো