মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পটিকে সার্থক ছোটোগল্প বলা যায় কিনা বিচার করো

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কে বাঁচায়, কে বাঁচে' গল্পটিকে সার্থক ছোটোগল্প বলা যায় কিনা বিচার করো
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পটিকে সার্থক ছোটোগল্প বলা যায় কিনা বিচার করো।
কেবল আকারে ছোটো হলেই তাকে ‘ছোটোগল্প’ বলা যায় না, এর নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। সার্থক কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে!’ গল্পটির যে সকল বৈশিষ্ট্যের জন্য একে সার্থক ছোটোগল্প বলা যায় সেগুলি হল-

স্বল্প আয়তন ও সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু: ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে!’ গল্পটি আকারে বেশ ছোটো, পাঠক একক পাঠেই গল্পটি শেষ করতে পারেন। আর এ গল্পের কাহিনি অংশ সামান্যই -মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী মৃত্যুঞ্জয় অফিসে যাওয়ার সময় ফুটপাথে অভুক্ত মানুষের মৃত্যু দেখে মানসিক আঘাত পায়। সেই আঘাতে তার জীবনপ্রবাহ ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে-দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের কল্যাণে অর্থ, খাদ্য দান করেও তৃপ্ত হয় না সে। শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্তের খোলস ছেড়ে সর্বহারাদের একজন হয়ে তাদের দুঃখ কষ্টের উপলব্ধির গভীরতায় পৌঁছে যায়।

একমুখীন ও শাখাপ্রশাখাহীন: তেতাল্লিশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে এ গল্পের পরিণতি একমুখীনভাবে এগিয়েছে। গল্পের সূচনায় দুর্ভিক্ষের এক নির্মম চিত্র রয়েছে, আর এরপর মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের তীব্রতম মানসিক প্রতিক্রিয়া কোন্ পর্যায়ে পৌঁছায়, সেই জিজ্ঞাসাই গল্পকে পরিণতির দিকে দ্রুত টেনে নিয়ে গিয়েছে।

স্বল্প সংখ্যক চরিত্র: মাত্র তিনটি চরিত্রই গল্পের কাহিনিকে পরিণতি দিয়েছে। তবে এ গল্পে কাহিনির চাইতে গুরুত্ব পেয়েছে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের ক্রম রূপান্তর। মাত্র দুটি পার্শ্ব চরিত্র-টুনুর মা (সহযোগী) এবং নিখিল (বিপরীত)-এর উপস্থিতি ‘ছোটোগল্পের’ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পূরণ করেছে।

চরম মুহূর্ত বা ক্লাইম্যাক্স: গল্পের শুরুতে তীব্র মানসিক আঘাতে যে পথে ছাপোষা মৃত্যুঞ্জয় যাত্রা শুরু করেছিল তারই স্বাভাবিক পরিণতি তার ভিক্ষা গ্রহণ। তাই শেষে “গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও।”-উক্তিতে এ গল্পের চরম মুহূর্ত (Climax) প্রকাশ পায়।

বৃহতের ব্যঞ্জনা: মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের বৃহত্তর মানবিক চেতনা লেখকের গভীর সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচায়ক। অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনযাপনের মধ্যে থেকে সর্বহারা মানুষদের জীবন যন্ত্রণার সমান অংশীদার হওয়া সম্ভব নয়। তাই মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবার, অফিস ত্যাগ করে মগ হাতে ছিন্নবস্ত্রে লঙ্গরখানায় অভুক্তদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খাবার গ্রহণ মেকি সমাজসেবার পর্দা খুলে দেয়।

সহজ-সরল ভাষা : এ গল্পের গদ্যরীতি ও ভাষা অতিসংক্ষিপ্ত, সংযত ও ভারহীন। ভাষা কোথাও গল্পের গতিতে বাধা দেয়নি।

অন্তরে অতৃপ্তি : গল্পের পরিশেষে অন্তরের অতৃপ্তি ছোটোগল্পের শৈলীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ গল্পের শেষে মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের পরিণতি পাঠকের মনে বেশখানিকটা তৃপ্তি দিলেও মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবারের অন্যদের পরিণতিটি জানার জন্য পাঠক উদ্‌গ্রীব থাকে।

Leave a Comment