ভিয়েনা সম্মেলনের কার্যাবলির একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করো। |
ভূমিকা
ভিয়েনা-সম্মেলনের সমালোচনা
প্রকৃত সম্মেলন নয়: ভিয়েনা সম্মেলনে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ অংশ গ্রহণ করলেও ইংল্যান্ড, রাশিয়া, প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স এই পাঁচটি শক্তি মুখ্যভূমিকা গ্রহণ করে। সব সিদ্ধান্ত আগের থেকেই গোপন বৈঠক করে ঠিক করে রাখা হত। ফলে যোগদানকারী অন্যান্য দেশগুলির কোনো ভূমিকাই ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই এই সম্মেলনকে প্রকৃত সম্মেলন বলাই যায় না।
নীতি প্রয়োগের ত্রুটি: ভিয়েনা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বাস্তবে যে তিনটি নীতি (ন্যায্য অধিকার, ক্ষতিপূরণ, শক্তি সাম্য) প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তা বাস্তব ক্ষেত্রে সব জায়গায় সমানভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়নি অর্থাৎ নিজেদের তৈরি করা নীতি নিজেরাই মেনে চলেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ভেনিসে পূর্বের ন্যায় প্রজাতন্ত্র ফেরানো হয়নি। অর্থাৎ ইটালির ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার প্রয়োগ করা হয়নি।
গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস সাধন: ফরাসি বিপ্লব ইউরোপের দেশগুলিতে যে জাতীয়তাবাদের জোয়ার এনেছিল, ভিয়েনা চুক্তি প্রণেতাগণ সেই জাতীয়তাবাদকে অবজ্ঞা করে লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে গণতন্ত্র, উদারতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ধ্বংস সাধন করেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সমস্ত জার্মান জাতিকে এক রাষ্ট্র গঠন করতে না দিয়ে এক অসংবদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা স্থাপন করা হয় এবং অস্ট্রিয়াকে এর সভাপতিত্বদান করা হয়। ইটালির জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে ইটালিকে আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত করে দিয়ে ভৌগোলিক সংজ্ঞায় পরিণত করা হয়।
ঘোষিত উচ্চ আদর্শের বাস্তবায়নে অনীহা : সম্মেলনের প্রারম্ভে কর্মকর্তারা অনেক উচ্চ আদর্শের কথা ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা পর্যবসিত হয়নি বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং গোপন চুক্তি কার্যকরী করাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিক্রিয়াশীল : ভিয়েনা সম্মেলনের কর্ণধাররা সকলেই ছিলেন রাজতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারে বিশ্বাসী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদ। নানা অজুহাতে, বিশেষত ন্যায্য অধিকার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তারা ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পূর্বের অবস্থাকেই ফিরিয়ে আনেন।
অযৌক্তিকতা: ভিয়েনা-কংগ্রেস পোল্যান্ডবাসীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে পোল্যান্ড ব্যবচ্ছেদ এবং জাতি ধর্ম ঐতিহাসিক বিবর্তন উপেক্ষা করে বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের অধীনে স্থাপন-এই দুই ব্যবস্থাই ছিল অযৌক্তিক।
সম্পদ ভাগ করে নেওয়া: ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবর্গ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য নিজেদের মধ্যে বিজিতদের সম্পদ ভাগ করে নিয়েছিলেন। বিপ্লব প্রসূত সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শগুলি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করেছিলেন।
কালের গতির বিরুদ্ধাচরণ: ভিয়েনা সম্মেলনের প্রতিনিধিরা বিপ্লব প্রসূত নব আদর্শ ও পুরাতনতন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা যুগধর্মকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে তারা তাল মেলাতে ব্যর্থ হন। ঐতিহাসিক গর্ডন ক্রেইগ বলেছেন যে, ভিয়েনা সম্মেলনের উদ্যোক্তারা তখন ফরাসি বিপ্লব প্রসূত আধুনিক ভাবধারাগুলি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইউরোপে অশান্তি দেখা দিত।