ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের কারণ কী ছিল – আজকের পর্বে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের কারণ কী ছিল তা আলোচনা করা হল।
ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের কারণ কী ছিল
ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লবের কারণ কী ছিল? |
ভূমিকা
পরাজিত নেপোলিয়নকে এলবা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হলে ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে ফ্রান্সের বুরবোঁ বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। সিংহাসনে বসেন ষোড়শ লুইয়ের ভ্রাতা অষ্টাদশ লুই। তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার ভাই দশম চার্লস। দশম চার্লসের সময়ে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে যে বিপ্লবটি ঘটে সেটি জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত।
জুলাই বিপ্লবের কারণ রাজতন্ত্র বনাম জাতীয়তাবাদের দ্বন্দু ছিল জুলাই বিপ্লবের মূল কারণ। এ ছাড়া অন্যান্য যে সমস্ত কারণগুলি ছিল :
(ক) অষ্টাদশ লুইয়ের শাসনব্যবস্থা
১৮১৫ থেকে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাসি সিংহাসনে ছিলেন অষ্টাদশ লুই। ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে সিংহাসনে বসলেও তিনি বুঝেছিলেন কঠোর প্রতি বিপ্লবী ব্যবস্থা স্থাপন বা চতুর্দশ লুইয়ের মতো চরম একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ফ্রান্সে সম্ভব নয়। তাই তিনি মধ্যপন্থা নীতি অনুসরণ করে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসনিক সনদ অনুমোদন করে। নির্বাচিত প্রতিনিধি সভা মেনে নেন, সাম্য, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মেনে নিলে উগ্ররাজতন্ত্রীরা অখুশী হন অন্যদিকে অষ্টাদশ লুইয়ের সময়ে অভিজাতরা তাদের আগের অধিকার পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হলে ফরাসি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
(খ) অষ্টাদশ লুইয়ের স্বৈরাচারিতা
প্রথম দিকে উদার রাজতন্ত্রের আদর্শ গ্রহণ করলেও ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী দ্যুদ দ্য বারি নিহত হলে অষ্টাদশ লুই স্বৈরাচারি হয়ে ওঠেন। প্রজাতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অযোগ্য বৃদ্ধ অষ্টাদশ লুইয়ের রাজত্বের শেষদিকে উগ্রপন্থী রাজতান্ত্রিক দল প্রাধান্য বিস্তার করলে ফরাসি জনগণ আবার বিদ্রোহের পক্ষ বেছে নেন। কেননা তার সময়ে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চরম দুর্দশা দেখা দেয়। খ্রিস্টাব্দে
(গ) দশম চার্লসের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি
১৮২৪ অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যু হলে সিংহাসনে বসেন দশম চার্লস। তিনি উগ্ররাজতন্ত্র ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা ও পুরানো পন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর আমলে অষ্টাদশ লুই-এর বিপরীত প্রবণতা দেখা দেয়। সিংহাসনে বসে তিনি অষ্টাদশ লুইয়ের সনদ বাতিল করে দেন। যাজকদের সাহায্যে দেশ চালাতে থাকেন। অভিজাতদের পুনর্বাসন ও রাজকোশ থেকে তাদের আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন, ধর্মীয় আলোচনা বন্ধ করার জন্য আইন পাশ করেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করে জেসুইটদের ফিরিয়ে আনেন। চার্চের স্বাধীনতা সুযোগসুবিধে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই কারণে তার সরকারকে বলা হত ‘Government by priests, through priests, for priests, দশম চার্লস সমস্ত রকম সংস্কার বিরোধী ছিল না। স্বাভাবিকভাবে এই উগ্র রাজতান্ত্রিক ও জনতান্ত্রিক আদর্শের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে।
(ঘ) জুলাই অর্ডিন্যান্স
উগ্ররাজপন্থায় বিশ্বাসী দশম চার্লস ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জুলাই চারটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন যেখানে বলা হয়েছিল। (১) সংসদ তথা প্রতিনিধি সভা ভেঙে দেওয়া (২) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা (৩) সংশোধিত নির্বাচনী আইনে নির্বাচকদের সংখ্যা তিন-চতুর্থাংশ কমিয়ে আনা (৪) জাতীয় সভার নতুন নির্বাচনের একটি দিন স্থির করা।
(ঙ) প্যারিস বিদ্রোহ
এর প্রতিবাদে প্যারিসের সর্বত্র সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটে। উদারপন্থী থিয়ার্সের নেতৃত্বে বিদ্রোহ চলতে থাকলে দশম চার্লস সেনাবাহিনীর সাহায্যে সেই বিদ্রোহ দমন করতে চেষ্টা করলে বেশির ভাগ রাজকীয় সেনা বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে। ফলে দশম চার্লস বিদ্রোহীদের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে স্টিমটের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ফলে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
উপসংহার
দশম চার্লস সিংহাসনচ্যুত হলে বিপ্লবীরা লুই ফিলিপকে সিংহাসনে বসান। তিনি জনগণের ভোটাধিকার সম্প্রসারিত করেন। ক্রমশ জুলাই বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আর শুরু হয়ে যায় বিপ্লব।