নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা পর্যালোচনা করো। বাংলায় নব্যবঙ্গ আন্দোলন কী প্রভাব ফেলেছিল |
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা পর্যালোচনা করো। বাংলায় নব্যবঙ্গ আন্দোলন কী প্রভাব ফেলেছিল? |
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা
নব্যবঙ্গ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলি হল-
নেতিবাচক কর্মসূচি
হিন্দুধর্ম বা পাশ্চাত্য সভ্যতা-কোনোটির সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা না থাকা সত্ত্বেও নব্যবঙ্গীয়রা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে নিন্দা এবং নেতিবাচক কর্মসূচি গ্রহণ করায় জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেন।
শহরকেন্দ্রিকতা ও দরিদ্র শ্রেণির প্রতি অবহেলা
অভিজাত পরিবারের কিছু শহুরে শিক্ষিত তরুণ বুদ্ধিজীবী ছাড়া দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কোনো যোগসূত্র ছিল না। নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর কার্যকলাপ সমাজের নীচুতলার মানুষকে স্পর্শ করেনি।
সীমাহীন প্রগতিশীলতা
ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা সমাজের সীমাহীন প্রগতিশীলতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু এই প্রগতিকে সাদরে গ্রহণ করার মতো পরিবেশ তখনও পর্যন্ত ভারতীয় সমাজে তৈরি হয়নি।
সংস্কারবিমুখতা ও ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তন
ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা ডিরোজিও-র মৃত্যুর পরে আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন এবং চাকুরি বা রোজগারের আশায় ব্যাবসা শুরু করেন। ফলে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
বাংলায় নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রভাব
প্রচলিত কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলন
পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে এবং মিল, বেথাম, পেইন, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের রচনাপাঠের ফলে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর তরুণ সদস্যদের মনে হিন্দুসমাজে প্রচলিত কুসংস্কারগুলির অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। তাঁরা বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, কুলীন প্রথা, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত পার্থেনন পত্রিকার মাধ্যমে তাঁরা প্রচলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক মতামত ব্যক্ত করেন।
সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ডিরোজিও-র প্রতিষ্ঠিত নব্যবঙ্গ দল সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছিল। তাঁরা গোমাংস ভক্ষণ করতেন এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের লক্ষ করে বলতেন-‘আমরা গোমাংস ভক্ষণ করি গো।’ গঙ্গাজলের পবিত্রতা অস্বীকার করতে বা উপবীত ছিঁড়ে ফেলতেও তাঁরা দ্বিধাগ্রস্ত হতেন না। নব্যবঙ্গের সদস্য কৃয়মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এনকোয়ারার পত্রিকায় সমাজের রক্ষণশীল সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা হয়। নব্যবঙ্গীয়রা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে শবব্যবচ্ছেদ সম্পর্কে গতানুগতিক সংস্কার ভেঙে ফেলার ডাক দেন। বেশকিছু নব্যবঙ্গীয় খ্রিস্টধর্মেও ধর্মান্তরিত হন।
যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা
নব্যবঙ্গীয়দের প্রতিষ্ঠিত অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছিল তরুণদের মধ্যে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটানোর একটি মাধ্যম। এ ছাড়া ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রকাশিত জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার মাধ্যমেও যুক্তিবাদের প্রসার ঘটেছিল।
রাজনৈতিক সচেতনতা
ক্যালাইডোস্কোপ, হেসপেরাস, ক্যালকাটা লিটেরারি গেজেট প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে ডিরোজিও ভারত সরকারের বিরোধিতা করেন। এ ছাড়া দেশ হিতৈষণা সভা, বেঙ্গল স্পেকটেটর প্রভৃতি সমিতিও জাতীয়তাবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘A Nation in Making’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, “ইয়ং বেঙ্গলরা ছিলেন বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক। তাঁরা আমাদের ‘জাতির পিতা’ -তাঁদের গুণাবলি চিরস্মরণীয়।”
আরও পড়ুন – স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ও শেখ মুজিবর রহমানের ভূমিকা আলোচনা করো