ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্পায়নের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে ‘আলোচনা করো। ভারতের শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কী জানো?

ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্পায়নের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে 'আলোচনা করো। ভারতের শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কী জানো
ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্পায়নের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে ‘আলোচনা করো। ভারতের শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে কী জানো?

ঔপনিবেশিক ভারতে শিল্পায়নের সামাজিক প্রভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে শিল্পক্ষেত্রে ইউরোপীয় মূলধন বিনিয়োগের পাশাপাশি ভারতীয় মূলধনের অনুপ্রবেশ ঘটার ফলে ভারতীয় শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। ভারতের সামাজিক ক্ষেত্রে শিল্পায়নের বিভিন্ন প্রভাব পড়েছিল। 

ইতিবাচক প্রভাব

  • নতুন নগরের সৃষ্টি: ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় নতুন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হলে সেই শিল্পকে কেন্দ্র করে মানুষের সমাগম ঘটতে থাকে, যা নতুন নগরের জন্ম দেয়।
  • অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন: ভারতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটলে কৃষিভিত্তিক দেশীয় অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার হয়। শিল্পায়নের প্রভাবে ভারতীয় অর্থনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা দেয়।
  • গ্রামজীবনে অবক্ষয়: ঔপনিবেশিক সরকারের ছত্রছায়ায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন শহর। গ্রামের কৃষিজীবী মানুষরা অধিক লাভের আশায় শহরে এসে জমা হতে থাকে। ফলে গ্রামগুলির আর্থসামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে।
  • শ্রমিক ও মালিক শ্রেণির উদ্ভব: ঔপনিবেশিক শাসনের ফলাফল হিসেবে ভারতে দুটি শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল- মালিক শ্রেণি এবং হতদরিদ্র শ্রমিক শ্রেণি।
  • জাতীয়তাবাদের সঞ্চার: নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ভিন্ন জীবিকা, সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের সমাগম ঘটে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানের সূত্রে জাতীয়তাবাদের সঞ্চার ঘটে।

নেতিবাচক প্রভাব

কৃষকদের দুরবস্থা: শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা জোগান দেওয়ার জন্য গ্রামের কৃষকদের নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পরিবর্তে শিল্পে প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করতে বাধ্য থাকতে হত।

ভারতে শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ

এদেশে শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্নভাবে।

শিল্পশ্রমিকের উদ্ভব:

  • মন্থর গতি: ঔপনিবেশিক সরকারের অধীনে শিল্পকারখানা গড়ে উঠলেও শিল্পায়নের অগ্রগতি হয়েছিল খুবই ধীর গতিতে। মোট জনসংখ্যার খুব সামান্য অংশই এতে অংশগ্রহণ করেছিল।
  • পেশার পরিবর্তন: ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে শিল্পকারখানাগুলি প্রতিষ্ঠিত হলে অধিক ও নিশ্চিত আয়ের আশায় গ্রাম থেকে বিপুল সংখ্যক কৃষক ও কুটিরশিল্পীরা শহরে এসে ঠিকাদারদের অধীনে নিযুক্ত হয়।
  • জীবনযাত্রার মান : শহরের অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাসরত এই শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা ছিল দিনে ১৫-১৮ ঘণ্টা। ১৮৮১ বা ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের কারখানা আইন সত্ত্বেও তাদের জীবনের বা চাকুরির কোনো নিরাপত্তা ছিল না। শিক্ষা ও চিকিৎসারও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অসামাজিক কাজ, নেশা করা ইত্যাদি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।

শিল্পশ্রমিকের বিকাশ :

  • শ্রমিক অসন্তোষ: বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করত। দীর্ঘ কাজের সময়, সামান্য মজুরি এবং মালিক শ্রেণির অবহেলা শ্রমিকদের মালিকবিরোধী করে তোলে।
  • শ্রমিক সংগঠন: বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষিপ্তভাবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে। পি সি যোশি, সুভাষচন্দ্র বসু, গান্ধিজি, শশীপদ ব্যানার্জি, দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ শ্রমিকদের সর্বতোভাবে সাহায্য ও সমর্থন করেছিলেন। গান্ধিজির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় মজদুর মহাজন সংঘ। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে আহমেদাবাদ টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই একই বছরে মাদ্রাজ লেবার অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে শিল্পশ্রমিকেরা যৌথভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। সর্বোপরি, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা শ্রমিক সংগ্রামের মঞ্চ হিসেবে গড়ে ওঠে।

Leave a Comment