ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির ভূমিকা আলোচনা করো

ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির ভূমিকা আলোচনা করো
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ম্যাৎসিনির ভূমিকা আলোচনা করো।
প্রথম অংশ: 

ভূমিকা

ইটালির ঐক্য আন্দোলনের পিছনে কার্বোনারির মতো বিভিন্ন গুপ্ত সমিতি, বিভিন্ন দেশপ্রেমিক ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার মতো ইটালির বিভিন্ন রাজ্যের বিশেষ অবদান ছিল। ইটালীয় দেশপ্রেমিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন যোশেফ ম্যাৎসিনি।

ম্যাৎসিনির আদর্শ ও উদ্দেশ্য

দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনির জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইটালির স্বাধীনতা অর্জন ও ঐক্যসাধন। তাঁর আদর্শ ও উদ্দেশ্যগুলি ছিল-

জনশক্তি: যদিও তিনি প্রথমদিকে ‘কার্বোনারি’র সভ্য হয়েছিলেন, কিন্তু একথা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ষড়যন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন বিপ্লব দ্বারা স্বাধীনতা বা জাতীয় ঐক্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তাঁর মতে জনসাধারণের সমবেত শক্তির দ্বারাই বিপ্লবের সফলতা অর্জন করা সম্ভব।

অস্ট্রিয়ার আধিপত্য দূরীকরণ: তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, দেশের ঐক্য ও অগ্রগতির জন্য প্রথম কর্তব্য হচ্ছে অস্ট্রিয়ার আধিপত্যের অবসান ঘটানো এবং অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

যুবশক্তির ওপর গুরুত্ব : তিনি ইটালির যুবশক্তিকে আত্মনির্ভরশীল হবার এবং নিজশক্তি দ্বারা অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরমুখাপেক্ষী হওয়া তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল। তাঁর বাণী ছিল, “Never rise in any other name than that of all Italy.” তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিজশক্তির ওপর নির্ভর করেই এই কর্তব্য সম্পাদন করা যায়।

প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ: ম্যাৎসিনির রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রজাতন্ত্রী, তিনি রাজতন্ত্রে বা স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক।

দ্বিতীয় অংশ: 

ম্যাৎসিনির কর্মপন্থা

ইয়ং-ইটালির প্রতিষ্ঠা: ইটালিতে যুবশক্তির উন্মেষ ও গণ জাগরণ ঘটানোর উদ্দেশ্যে ম্যাৎসিনি ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে নব্য ইটালি বা ‘ইয়ং-ইটালি’ নামক একটি জাতীয়তাবাদী যুব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। চল্লিশ বছরের নীচে স্বদেশভক্ত ইটালিবাসীরাই কেবল এর সদস্য হতে পারতেন।

ইয়ং-ইটালির বিস্তার: ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই দলের সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ৬০,০০০-এ। শরীরচর্চা, অস্ত্রশিক্ষা প্রভৃতির মাধ্যমে এই সংগঠনের সদস্যদের স্বাধীনতার আদর্শে দীক্ষিত করা হত এবং এই দলের যে পতাকা ছিল তার একদিকে লেখা ছিল “স্বাধীনতা ও ঐক্য” এবং অন্যদিকে লেখা ছিল “গণতন্ত্র, সাম্য ও মানবতা”।

১৮৩৩-১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলন: ম্যাৎসিনি ও ইয়ং-ইটালি ষড়যন্ত্র বা গুপ্ত হত্যা বা বিপ্লববাদে বিশ্বাসী ছিল না। বরং ইয়ং-ইটালি গণ জাগরণ বা জন জাগরণের মাধ্যমেই ইটালির থেকে অস্ট্রিয়ার আধিপত্যের অবসান করে ইটালিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ১৮৩৩, ১৮৩৪, ১৮৪১ ও ১৮৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট, নেপলস, ক্যালব্রিখ প্রভৃতি স্থানের বিপ্লবাত্মক ঘটনার সঙ্গে ম্যাৎসিনির ও ইয়ং-ইটালির যোগসূত্র ছিল।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকালে ম্যাৎসিনির আন্দোলন : তবে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের গণবিপ্লব সম্পন্ন হয় ইয়ং-ইটালির সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় এবং এর পরিণতিতে ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে রোম ও টাস্কানিতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সের দমননীতির ফলে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

ম্যাৎসিনির আন্দোলনের ব্যর্থতা

ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে পরিচালিত ইটালির ঐক্য আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলি হল-
  • আদর্শবাদী ম্যাৎসিনির মধ্যে বাস্তববাদী নেতার গুণাগুণ না থাকার ফলে তিনি পরিস্থিতিকে নিজ আয়ত্তে আনতে পারেননি;
  • প্রজাতন্ত্রে বিশ্বাসী হওয়ার ফলে রাজতন্ত্রের সমর্থক দল ও সম্প্রদায়গুলি তাঁর বিরোধিতা করে; 
  • বৈদেশিক সাহায্য নীতি গ্রহণ না করে তিনি রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন, কারণ ইটালির পক্ষে প্রবল শক্তিমান অস্ট্রিয়ার সামরিক ক্ষমতা বিপর্যস্ত করা সম্ভব ছিল না।

উপসংহার

সমস্ত ইটালিতে এক গভীর হতাশার মধ্যে ম্যাৎসিনি আশা ও অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, দেশাত্মবোধ, আত্মত্যাগ এবং সর্বোপরি তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ইটালিকে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে নতুন পথে পরিচালিত করেছিল। ঐতিহাসিক সি. ডি. হ্যাজেন যথার্থই বলেছেন যে, ম্যাৎসিনি ছিলেন ইটালির পুনর্জাগরণের আধ্যাত্মিক শক্তি, নতুন ইটালির পথপ্রদর্শক।

Leave a Comment