|
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধ রচনা
|
ভূমিকা
আপামর বাঙালির কাছে উত্তমকুমার যদি হন ‘মহানায়ক’, তাহলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে এক যুগপুরুষ। আমাদের কাছে তিনি কেবলমাত্র এক মহান অভিনেতাই নন, বাংলা সংস্কৃতির এক ভাস্বর প্রতিভূ। তিনি একাধারে অভিনেতা, বাচিকশিল্পী, কবি, চিত্রকর, পত্রিকা-সম্পাদক এবং সর্বোপরি এক সহজসরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাছের মানুষ, প্রিয় শিল্পী। তিনি একই সঙ্গে ‘অপু’ এবং ‘ফেলুদা’। বাঙালির চিরকালীন আবেগ অনুভূতির এক মূর্তরূপ ছিলেন তিনি। বাংলা তথা বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি সুদীর্ঘ সময় জুড়ে লালিতপালিত হয়েছে যে মহিরুহের স্নিগ্ধ ছায়ায়, তার নাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম শিয়ালদহ রেলস্টেশনের নিকটবর্তী মির্জাপুর স্টিটের বাড়িতে ১৯৩৫ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষদের বংশানুক্রমিক বাসস্থান ছিল বাংলাদেশে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠাকুরদা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। জীবনের প্রথম দশ বছর সৌমিত্র অতিবাহিত করেন কৃষ্ণনগরে। প্রখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের উৎসাহ উদ্দীপনায় সেখানে বহাল ছিল এক সমৃদ্ধ নাট্য সংস্কৃতি। সৌমিত্রর বাবা, মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় পেশায় আইনজীবী ও পরে সরকারি কর্মচারী হলেও শখের নাট্যাভিনেতা ছিলেন। সৌমিত্রর মায়ের নাম ছিল আশালতা চট্টোপাধ্যায়।
শিক্ষাজীবন
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পড়াশোনা শুরু হয় কৃষ্ণনগরের সেন্ট জন্স স্কুলে। বাবার বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদে তাঁরা কৃষ্ণনগর থেকে চলে আসেন হাওড়ায়, যেখানে সৌমিত্র হাওড়া জেলা স্কুলে ভরতি হন। বিএ অনার্স (বাংলা) পাস করেন তিনি কলকাতার সিটি কলেজ থেকে, স্নাতকোত্তর পড়াশোনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বাংলা নাট্যজগতের দুই দিকপাল অহীন্দ্র চৌধুরী ও শিশির ভাদুড়ির কাছে অভিনয়ের তালিম নেন।
কর্মজীবন
পরবর্তীতে আকাশবাণী কলকাতার ঘোষকের পদে নিযুক্ত হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন আগামী দিনের ‘অপুর সংসার’-এর অপু। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসাঘর’ সিনেমার শ্যুটিং দেখতে গিয়েছিলেন তরুণ সৌমিত্র। শ্যুটিং শেষে তিনি যখন সেট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, সত্যজিৎ রায় তাঁকে ডাকেন। পাশে বসা ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “এ সৌমিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমার ‘অপু ট্রিলজি’-র পরবর্তী ছবি ‘অপুর সংসারে’ ও অপুর চরিত্রে অভিনয় করবে।”
অভিনয়
১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘অপুর সংসার’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত প্রথম ছবি। এরপর সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চোদ্দোটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘অভিযান’ (১৯৬২), ‘চারুলতা’ (১৯৬৪), ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৯), ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) প্রভৃতি। আন্তর্জাতিক মহলে বহুক্ষেত্রেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘আ রে অ্যাকটর’ (a Ray actor) হিসেবে পরিচিত। সত্যজিৎ রায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জুটিকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আকিরা কুরোসাওয়া ও তোসিরো মিফুন, ইংগ্লার বার্গম্যান ও ম্যাক্স ভন সাইডো, মার্টিন স্করসেস ও লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিয়ো বা ফেডেরিকো ফেলিনি ও রবার্ট ডি নিরো প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত জুটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। রুপোলি পর্দায় প্রায় পাঁচ দশক ধরে নানারূপে ও নানা মহিমায় বিরাজমান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন প্রায় আড়াইশোটি ছবিতে। যার মধ্যে রয়েছে মৃণাল সেন পরিচালিত ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫); তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ (১৯৬০), ‘ঝিন্দের বন্দি’ (১৯৬১), ‘আতঙ্ক’ (১৯৮৬); তরুণ মজুমদারের ‘সংসার সীমান্তে’ (১৯৭৫), ‘গণদেবতা’ (১৯৭৮); অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’ (১৯৬৩), ‘পরিণীতা’ (১৯৬৯)-র মতো ছবি।
এ ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে কয়েকটি হল- ‘বাক্সবদল’ (১৯৭০), ‘বসন্ত বিলাপ’ (১৯৭৩), ‘ছুটির ফাঁদে’ (১৯৭৫), ‘কোনি’ (১৯৮৬) ইত্যাদি। তাঁর সাম্প্রতিক যে ছবিগুলি সাধারণ দর্শক ও বিদগ্ধ মহলের প্রশংসা লাভ করেছে সেগুলি হল- ‘অংশুমানের ছবি’ (২০০৯), ‘হেমলক সোসাইটি’ (২০১২), ‘বেলাশেষে’ (২০১৫), ‘প্রাক্তন’ (২০১৬), ‘পোস্ত’ (২০১৭), ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ (২০১৮), ‘সাঁঝবাতি’ (২০১৯) প্রভৃতি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নাটকেও ছিলেন সমান দক্ষ। ১৯৬৩ সালে ‘তাপসী’ নাটকে প্রথম আত্মপ্রকাশ। তারপর ‘রাজকুমার’, ‘ফেরা’, ‘টিকটিকি’ প্রভৃতি নাটকে তিনি তাঁর মঞ্চাভিনয়ের পারদর্শিতার নিদর্শন রেখে গেছেন।
সাহিত্যের প্রতি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ছিল প্রবল অনুরাগ। কবিতা, প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি বিখ্যাত ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছেন বহুদিন।
পুরস্কারপ্রাপ্তি
তিনি ২০০৪ সালে পান ‘পদ্মভূষণ’, ২০১২ সালে সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’, ২০১৭ সালে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার। একই বছরে তিনি ফরাসি সরকারের লিজিঅন দ্য’ অনর (Legion d’ Honneur) পুরস্কারে সম্মানিত হন।
উপসংহার
২০২০ সালের ৫ অক্টোবর ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় করোনায় আক্রান্ত। অন্যান্য শারীরিক সমস্যা, বার্ধক্য সব মিলিয়ে সৌমিত্র ওরফে ‘ক্ষিদ্দা’ ‘ফাইট’ ব্যাক করলেও শেষরক্ষা হয় না। ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
‘হয়তো তোমারই জন্য’, ‘আরও দূরে চলো যাই’, ‘সাগর ডাকে আয়’, ‘লেগেছে, লেগেছে, লেগেছে আগুন’, ‘জীবনে কি পাব না’-এরকম আরও বহু চিরন্তন গানের সঙ্গে বাঙালির মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে যে তারুণ্যের ছবি, তাকে নশ্বরতা গ্রাস করতে পারেনি, পারবেও না। মৃত্যু তাকে প্রদান করেছে সেই অমরত্ব, যা কীর্তিমান মানুষদের একান্ত নিজস্ব অধিকার।