সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো। |
ভূমিকা
ভারতীয় সমাজের সংস্কার আন্দোলনে ‘ভারত পথিক’ রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সর্বাগ্রগণ্য। সমাজের কুসংস্কার দূর করে আধুনিক সমাজ গঠনে রাজা রামমোহন রায় প্রথম সচেষ্ট হয়েছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, রামমোহন রায় ছিলেন সমকালীন বিশ্বের সেই ব্যক্তি যিনি আধুনিক যুগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন।
রাজা রামমোহনের সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্য
রাজা রামমোহনের সমাজসংস্কার আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল-
[1] কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ভারতীয় সমাজ গঠন করা,
[2] নারীসমাজের অবস্থার উন্নয়ন।
সমাজসংস্কার:
[1] সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন
সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের উচ্চবর্ণে অমানবিক সতীদাহপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে মৃত স্বামীর চিতায় তার জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। ধর্মশাস্ত্র ব্যাখ্যা-সহ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে রামমোহন এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন।
[2 ] নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা
রাজা রামমোহন রায় নারীদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর যাতে তার বিধবা স্ত্রী স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারে তার জন্য তিনি স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আন্দোলন করেন। কারণ তখন পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না।
[3] বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন
রামমোহন বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় শাস্ত্রের ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন যে, প্রাচীন শাস্ত্রে পুরুষের বহুবিবাহের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া হয়নি। তবে প্রাচীনকালে কোনো স্ত্রী ব্যাভিচারিণী, সুরাসক্ত ও বন্ধ্যা হলে পুরুষ পুনরায় বিবাহ করতে পারত।
[4] কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা
রামমোহন কৌলীন্য প্রথাবিরোধী ছিলেন। কারণ-এই কৌলীন্য প্রথার জন্যই সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অল্পবয়স্ক মেয়েদের মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হত।
[5] জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা
রাজা রামমোহন রায় জাতিভেদ প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে সমাজের মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করে প্রচার করেন।
[6] ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা
রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে যে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, তা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাত্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতেও রামমোহন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অবদান হল- শিক্ষাবিস্তার ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের চেষ্টা।
[1] শিক্ষাবিস্তার: রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নিজে ২২ বছর বয়সে ইংরেজি ভাষা শেখেন। তারপর ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের জন্য পটলডাঙায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ডেভিড হেয়ার-কে তিনি হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। কারও কারও মতে, তিনি হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ছিলেন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সময় সরকার সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যত হয়। তখন রামমোহন বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে এক স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে ইংল্যান্ডের মতো আধুনিক শিক্ষা চালু করার আবেদন জানান। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি পাদরি আলেকজান্ডার ডাফকে সাহায্য করেন।
[2] গণতান্ত্রিকতা: রামমোহন গণতন্ত্রের পূজারি ছিলেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব ও মনীষীদের রচনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকায় নিজ মত প্রচার করেন। তিনি সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ভাষারীতিতে স্বাধীন মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখেন।