শিশুসাহিত্য বাংলা রচনা
শিশুসাহিত্য বাংলা রচনা |
ভূমিকা
‘আয় আয় চাঁদ মামা’ কিংবা ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’ এমনসব ছেলেভুলানো ছড়া কিংবা রূপকথা, উপকথা, লোককথা, পশুকথা, নীতিকথার গল্পগুলিই আমাদের সমাজের সর্বপ্রাচীন শিশুসাহিত্য। যদিও এদের অধিকাংশই শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি হয়নি।
শিশুসাহিত্য কী?
শিশুদের উপযোগী সাহিত্যই শিশুসাহিত্য, এ সংজ্ঞাটি অতিসরলীকৃত হলেও শিশুসাহিত্য প্রকৃতার্থেই শিশুপাঠ্য সাহিত্যের প্রচলিত নাম। শিশুর সাহিত্য শোনার শুভারম্ভ ঘটে মা- মাসি-ঠাকুমা-দিদিমাদের কোলে শুয়ে-বসে তাঁদের মুখ থেকে ছড়া, গল্প শোনার মাধ্যমে। যদিও একটা বয়স পর্যন্ত শিশুদের কাছে সাহিত্য, তা সে যতই তাদের উপযোগী হোক-না-কেন, নিছক শ্রুতিমধুর, পরিচিত কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি ও সুরের সমন্বয় মাত্র। যা শুনতে শুনতে অভ্যাসবশত শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই ঘটে শিশুসাহিত্যের সঙ্গে প্রায় প্রতিটি শিশুরই প্রাথমিক পরিচয়।
শিশুসাহিত্যের উপাদান
পৃথিবীর সব দেশের শিশুসাহিত্যের সিংহভাগই জুড়ে রয়েছে রূপকথা ও উপকথাগুলি। এতে রয়েছে মূলত শুভ-অশুভের যুদ্ধ, যেখানে রাজপুত্র-রাজকন্যা, রাজা-রানি, রাক্ষস-রাক্ষসী, ডাইনিবুড়ি, বামন, দানব, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি, শুকশারিদের যাতায়াত। এ ছাড়াও ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, কমিক্স, মজার গল্প ইত্যাদিও কালে কালে শিশুসাহিত্যের দরবারে হাজির হয়েছে।
শিশুসাহিত্যিক ও তাঁদের রচনাসমূহ
বাংলা শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারকে চিরকালীন সমৃদ্ধি দিয়েছে অসামান্য সব লেখক-লেখিকার সৃজনশীলতা। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, বিদ্যাসাগর, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, জগদানন্দ রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়-এঁরা এক-একজন কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক। ‘পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল’ বা ‘হারাধনের দশটি ছেলে’ পাঠরত বাঙালিই রাখাল গোপালের কথা জেনে নিতে নিতে পাঠ করে ‘আজ মঙ্গলবার পাড়ার জঙ্গল সাফ করার দিন’ বা ‘আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকেবাঁকে’।
শিশুসাহিত্যের এই ধারাকে রূপকথার জগৎ দিয়ে অভিনব করেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, প্রসারিত করেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছেলেদের মহাভারত দিয়ে। তারপর আসেন অবিস্মরণীয় সুকুমার রায়-“কেউ কি জানো সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা/ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা”। রায় বাড়ির তৃতীয় পুরুষ সত্যজিৎ রায় ফেলুদার গোয়েন্দাকাহিনি, প্রফেসর শঙ্কুর কল্পবিজ্ঞানের গল্প এবং আরও নানা স্বাদের ছোটোগল্পের সম্ভার দিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্যকে জনপ্রিয়তার অনন্য স্তরে উন্নীত করেছেন। এই বাড়িরই কন্যা লীলা মজুমদার ‘হলদে পাখির পালক’, ‘পদি পিসির বর্মীবাক্স’ বা ‘নলিনী দাশ গোয়েন্দা গন্ডালু’ দিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। ঠাকুরবাড়িতেও ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ লেখেন গগনেন্দ্রনাথ।
বাংলা শিশুসাহিত্য শুধু নয় চিরকালীন বিশ্বশিশুসাহিত্যের চিরোজ্জ্বল ধ্রুবতারা অবন ঠাকুর। ‘রাজকাহিনি’, ‘নালক’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূতপত্রীর দেশে’, ‘ক্ষীরের পুতুল’ প্রভৃতি অমূল্য সাহিত্যকর্মের জনক তিনি। শরৎচন্দ্রের ‘লালু’, বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’, ‘হীরামানিক জ্বলে’ থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালাচাঁদ’, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘ভোম্বল সর্দার’ ইত্যাদি শিশুসাহিত্যের এই উন্নতধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখে।