শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী
শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী?

শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক

ভূমিকা

আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় শিক্ষার ধারাও (সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি) প্রচলিত ছিল সেসময়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে এদেশে শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। দেশীয় শিক্ষার জন্য প্রাচ্যবাদীরা এবং ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যবাদীরা এই টাকা দাবি করলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেষপর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হয়।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন

বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজরা এদেশীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। পরে এদেশীয়দের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করার জন্য খ্রিস্টধর্ম ও জনহিতবাদের ভিত্তিতে শিক্ষাবিস্তারের দাবি ওঠে। ইংল্যান্ডের এই জনমতের দাবিতে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের ৪৩ নং অনুচ্ছেদে এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও এর প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অসীম। কারণ এই নির্দেশের দ্বারা কোম্পানি সরকারকে এদেশীয়দের জনশিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব

সরকার কর্তৃক বরাদ্দ ১ লক্ষ টাকা পাওয়ার জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সরকার শিক্ষাখাতে অর্থব্যয় বন্ধ করে দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেয় একটি সমিতির উপর, যার নাম ছিল জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (GCPI)। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়।

[1] প্রাচ্যবাদী :
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি শিক্ষা দীর্ঘকাল ধরে চালু ছিল। এই শিক্ষাই হল প্রাচ্যশিক্ষা। এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদীদের নেতা। তাঁদের মতে, প্রাচ্যশিক্ষাই হল প্রকৃত শিক্ষা। কারণ এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই শিক্ষা জড়িত। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত। এই শিক্ষার জন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। তাই এই শিক্ষার উন্নতির জন্য সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।

[2] পাশ্চাত্যবাদী: বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা ও মফস্সল অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে পাস করা ছাত্ররা বাণিজ্যিক ও সরকারি চাকরি পেত। এজন্য এই ধরনের স্কুলের সংখ্যা ও ছাত্রসংখ্যা বেড়ে চলে। এই শিক্ষাই হল পাশ্চাত্য শিক্ষা। ট্রেভেলিয়ান, আলেকজান্ডার ডাফ, স্যান্ডার্স প্রমুখ ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী নেতা। তাঁদের মতে, ইংরেজি ভাষা হল আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষায় রচিত সাহিত্য অতি সমৃদ্ধ এবং তা ছাত্রদের চাকরি পাওয়ার উপযোগী। ভবিষ্যতে এই ভাষা এদেশের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে সমৃদ্ধ করবে। তাই ইংরেজি শিক্ষার জন্যই সরকারি টাকা বরাদ্দ করা উচিত।

রামমোহনের স্মারকলিপি

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থব্যয় বন্ধ করেছিল। শেষপর্যন্ত (১৮২৩ খ্রি.) সরকার ওই জমা টাকায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়। তখন রাজা রামমোহন রায় বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রটিকে স্মারকলিপি বলা হয়। এই স্মারকলিপিতে সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ইংল্যান্ডের মতো আধুনিক শিক্ষা ভারতে চালু করার কথা বলা হয়। রাজা রামমোহন রায় শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতিনিধি ছিলেন। তাই সরকার তাঁর এই মতকে গুরুত্ব দেয়।

দ্বন্দ্বের অবসান

মেকলে মিনিট: বড়োেলাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক-এর আইনসভার সদস্য স্যার থমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও শ্লেষ-সহ এক মন্তব্য প্রকাশ করেন, যা মেকলে মিনিট নামে পরিচিত। তিনি বলেন, ইউরোপের একটি ভালো লাইব্রেরির এক তাক বই সমগ্র প্রাচ্য সাহিত্যের থেকে মূল্যবান। তাঁর বাগ্মিতা ও যুক্তির দ্বারা বেন্টিঙ্ক প্রভাবিত হন। তিনি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু হয়। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। সরকারি ক্ষেত্রে ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার চালু হয়।

আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য আলোচনা করো

Leave a Comment