মেটারনিখ ব্যবস্থা (Meternich System) বলতে কী বোঝো? এই ব্যবস্থা কেন বার্থ হয়েছিল |
মেটারনিখ ব্যবস্থা
১৮১৫-৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ। উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রবল বিরোধী এবং রক্ষণশীলতার সমর্থক মেটারনিখ চেয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লবপূর্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করতে এবং অস্ট্রিয়ার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে ইউরোপের রাজনীতিতে তার একাধিপত্য বজায় রাখতে। এই স্বার্থগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে মেটারনিখ তাঁর দেশ অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপে তাঁর মতবাদকে যেভাবে প্রয়োগ করেন, তাকেই ‘মেটারনিখ ব্যবস্থা’ বলা হয়।
অস্ট্রিয়ায় মেটারনিখ ব্যবস্থা
ফরাসি বিপ্লবের প্রতি ছিল মেটারনিখের সীমাহীন ঘৃণা। তাঁর বিশ্বাস ছিল- বিপ্লবের জীবাণু সমগ্র ইউরোপের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে। তিনি মনে করতেন, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বহু জাতি অধ্যুষিত অস্ট্রিয় সাম্রাজ্যকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে। বিপ্লবী ভাবধারা যাতে অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বহু জাতিগোষ্ঠীর ও ভাষাভাষি মানুষের দেশ অস্ট্রিয়ায় তিনি বিভেদনীতির আশ্রয় নেন। অস্ট্রিয়ায় সকল প্রকার সংস্কার ও বিপ্লবী ভাবধারা নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন ও যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রসার যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখা হয়, ছাত্র ও অধ্যাপকদের গতিবিধির উপর নজরদারি করা হয়। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘কার্লসবাড ডিক্রি’ জারি করে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়।
মেটারনিখ জার্মানিকে ৩৯টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত করে একটি রাষ্ট্রমন্ডল গড়ে তোলেন। সেই রাষ্ট্রমন্ডলের সভাপতির আসনে বসান অস্ট্রিয়াকে। জার্মানিতে তিনি রক্ষণশীল নীতি প্রবর্তন করেন।
ইউরোপে মেটারনিখতন্ত্র
প্রাক্ বিপ্লব অবস্থা ও রক্ষণশীলতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তি সমবায় গঠিত হয়। এই সমবায়ের কাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ট্রপোর বৈঠকে বলা হয় যে, কোনো দেশে বিপ্লব ঘটলে শক্তি সমবায় সেখানে হস্তক্ষেপ করে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। এই ঘোষণা অনুসারে ইটালির নেপলস ও পিডমন্টের প্রজাবিদ্রোহ, ফ্রান্স ও স্পেনের উদারনৈতিক আন্দোলন দমন করা হয়। জুলাই বিপ্লবের ফলে ইটালির পার্মা, মডেনা ও পোপের রাজ্যে গণ আন্দোলন দেখা দেয়। গ্রিসের স্বাধীনতা সংগ্রামে রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার সাহায্য করতে অগ্রসর হলে মেটারনিখ তাঁকে নিবৃত্ত করেন।
মেটারনিখের সমর্থনে বলা যায়, ফরাসি বিপ্লবের সময় হিংসার আতিশয্য ও নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধে ইউরোপ যখন শাস্তি কামনা করছিল, মেটারনিখ তখন পুরাতনতন্ত্র কায়েম করে সুদীর্ঘ ৪০ বছর ইউরোপে শাস্তির পরিবেশ বজায় রেখেছিলেন।
মেটারনিখতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ
১৮১৫ থেকে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপের সর্বত্র মেটারনিখের আধিপত্য বজায় ছিল। কিন্তু ১৮৩০ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে ‘মেটারনিখ পদ্ধতি’ দ্রুত শিথিল হতে থাকে। নানা কারণে মেটারনিখতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল-
- অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা এবং সমকালীন যুগের ভাবধারাকে অস্বীকার করার ফলে এই ব্যবস্থা সফলতা পায়নি।
- মেটারনিখ পদ্ধতি ছিল নেতিবাচক, সুবিধাবাদী ও দমনমূলক।
- ফরাসি বিপ্লবের ধ্বংসাত্মক দিকের প্রতি মেটারনিখের দৃষ্টি পড়েছিল। বিপ্লবের গঠনমূলক দিকগুলি তিনি দেখতে পাননি।
- মেটারনিখ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইউরোপের সব দেশ সহযোগিতা করেনি। বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে না পারাই তাই প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিফলতার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে।