মানুষ ও গাছপালা রচনা
|
[রচনা-সংকেত: ভূমিকা – মানুষের সেবায় গাছপালা গাছ কাটার কুফল প্রতিকার উপসংহার]
ভূমিকা
মানুষই হল সভ্যতার প্রবলধারায় বইঠা টেনে যাওয়া এক এবং অদ্বিতীয় নাবিক। প্রবাহমান জীবনে তাদের চিরন্তন দাবি-
‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আসলে ভালোভাবে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে বড়ো স্বপ্ন। তাদের সেই একান্ত দাবিগুলো, ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলো পুরণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকে গাছপালা।
মানুষের সেবায় গাছপালা
প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধের পূজারি, Suffocating sensuousness-এর স্বপ্নরাজ্যে বিচরণকারী কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন-
‘অবিরল মরুভূমি ঘিরে
বিচিত্র বৃক্ষের শব্দে স্নিগ্ধ এক দেশ
এ পৃথিবী’
সেখানে মানবসেবার বীজমন্ত্র নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য গাছপালা, দাঁড়িয়ে আছে বিস্তীর্ণ সব অরণ্য। সেই ভূমিকা পালনে তারা যেসব কাজ করে থাকে, তা হল-
(ক) জীবনধারণে গাছপালা সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে গাছপালা জীবকুলকে ফুল দেয়, ফল দেয়, জোগান দেয় খাদ্যের। পশুপাখিদের আশ্রয়ও দেয়। পাশাপাশি তারা সমানে জোগান দিয়ে চলেছে জীবনধারণের উপযোগী অক্সিজেন।
(খ) সভ্যতার বিকাশে গাছপালা: সভ্যতার সূচনাপর্বে অরণ্যের গাছপালাই মানুষকে দিয়েছিল আশ্রয় ও উন্মেষের পাঠ। বনের দাবানল মানুষকে দিয়েছিল সেই আগুনের পরিচিতি, যে আগুনের ব্যবহারের ভিতর দিয়ে সভ্যতার শুরু।
(গ) জনজীবনে অরণ্য ও গাছপালা : অরণ্য ও গাছপালা মানুষকে দিয়ে চলেছে ফুল, ফল, কাঠ, আসবাব, খাদ্য, কয়লা। এছাড়াও এমন কিছু গাছ আছে, যা থেকে তৈরি জীবনদায়ী ওষুধ মানুষের অসুখ সারায়।
(ঘ) বায়ুদূষণ প্রতিরোধে গাছপালা : অরণ্য ও গাছপালা কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে বাতাসে উভয়ের মাত্রা বজায় রাখে এবং ওজনস্তরের ছিদ্র মেরামত করে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশে বাধা দেয়।
(ঙ) বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে অরণ্য ও গাছপালা বৃষ্টি না হলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। নানান ধরনের দূষণও বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় অরণ্য ও গাছপালা বৃষ্টি ডেকে এনে জীবন বাঁচায়। অরণ্য ধ্বংসের ফলে তাই বৃষ্টিপাত কমে যেতে দেখা যায়।
(চ) ভূমিদূষণ প্রতিরোধে গাছপালা গাছপালা ভূমিক্ষয় ও বন্যা প্রতিরোধ করে। পাশাপাশি ভূমির দূষণ কমাতেও যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করে।
গাছ কাটার কুফল
গাছপালার উপকারী ভূমিকা ভুলে গিয়ে মানুষজন দীর্ঘকাল ধরে গাছ কেটে গিয়েছে, ধ্বংস করে গিয়েছে বনাঞ্চল। তার ফলে খাদ্যশৃঙ্খলই আজ বিপন্ন। ক্রমশ দেখা দিচ্ছে অনাবৃষ্টি, বায়ুদূষণ, ভূমিদূষণ। বাড়ছে ভূমিক্ষয়, বন্যা। জীবনাদায়ী ওষুধেরও অভাব দেখা দিচ্ছে।
প্রতিকারের চেষ্টায় বৃক্ষরোপণ
বনাঞ্চল ধ্বংস করে যে মানুষ একদিন গড়ে ছিল নগর রাষ্ট্র, আজকের দিনে নিজেদের দুরবস্থা বুঝতে পেরে তারা সচেতন হতে শুরু করেছে। চারিদিকে আহবান উঠেছে-
“দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ, লোন্টু, কাষ্ঠ ও প্রস্তর।”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই অবস্থায় দিকে দিকে শুরু হয়েছে বৃক্ষরোপণ উৎসব। সরকারি ক্ষেত্রেও জনগণের মধ্যে চারাগাছ বিলিয়ে, সরকারি ফাঁকা জমিতে বনাঞ্চল সৃষ্টি করে শুভ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ভারতবর্ষে এই প্রচেষ্টা এখনও যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে আরও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, মানুষই পারে অরণ্য ও গাছপালাকে তাদের উপযুক্ত মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে। তাতে মানুষেরই লাভ। সে লাভ বর্তমানের যেমন, তেমনি আগামী বহুকালেরও। অরণ্যের তথা গাছপালার ব্যাপকতার পুনর্জীবন ঘটলে কোনো মানুষকেই পৃথিবীর কাছে আর ক্ষমা চেয়ে বলতে হবে না-
‘আ, পৃথিবী !
এখনো আমার ঘুম ভাঙেনি।’
-শঙ্খ ঘোষ