মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা রচনা

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা রচনা

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা রচনা
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা রচনা
[ রচনা-সংকেত: ভূমিকা-মাতৃভাষা কাকে বলে-মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা – সমস্যা-সমস্যার সমাধান-মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব-উপসংহার]

ভূমিকা

শিক্ষাকে ঘিরেই অন্যরকম হবার স্বপ্ন দেখে মানুষ। শিক্ষার দ্বারা-ই তারা গড়ে তোলে জীবনের মেরুদন্ড। সেই শিক্ষাকে সুদৃঢ় ভিত্তি দিতে গেলে যে-কোনো কালে, যে-কোনো দেশে মাতৃভাষা বিশেষ মাধ্যম হতে পারে। সেই কারণে কবি যথার্থই বলেছেন-‘মাতৃভাষা বিনে পুরে কি আশা?’

মাতৃভাষা কাকে বলে

একটি শিশু জন্মের পরে যে ভাষায় প্রথম কথা বলে, তাকেই বলে মাতৃভাষা। সেই ভাষা শিশু মূলত মায়ের কাছ থেকেই শেখে এবং ক্রমশ তা হয়ে ওঠে মাতৃদুগ্ধ সমান। এই মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিশুর মধ্যে প্রথম বোধের উন্মেষ ঘটে।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তা

মানুষ তার শিক্ষা গ্রহণ করে বাল্যকাল থেকেই। এই সময় থেকে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা ঘটলে কিছু সুবিধা দেখা দেয়। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-

‘বাল্যকাল হইতে যদি ভাষাশিক্ষা হয় এবং ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জীবনযাত্রা নিয়মিত হয়ে থাকে তবেই আমাদের সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা যথার্থ সামঞ্জস্য স্থাপিত হইতে পারে, আমরা বেশ সহজ মানুষের মতো হইতে পারি।’

এই সুবিধা ছাড়াও মাতৃভাষার মাধ্যমে আরও কিছু সুবিধা মেলে। সে সুবিধাগুলো হল-

(ক) সহজবোধ্যতা:
মাতৃভাষা যে-কোনো মানুষের আয়ত্বে থাকা সহজতম ভাষা বলে তার মাধ্যমে বহু কঠিন বিষয় শিক্ষার্থীরা সহজেই বুঝতে পারে। সেগুলো সম্পর্কে নিজস্ব মতামতের প্রকাশও ঘটাতে পারে।

(খ) বিদেশি ভাষা বোঝার অসুবিধা:
ইংরেজির মতো বিদেশি ভাষা কিংবা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে সহজবোধ্য হয় না। যেমন- উত্তর কোরিয়া এবং চিন দেশের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষা ভালো জানে না, ভারতবর্ষেও বহু শিক্ষার্থী ইংরেজিতে সাবলীল নয়। তাদের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হতে পারে।

(গ) সার্বিক বিকাশ: যে-কোনো দেশের যে-কোনো মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করে মাতৃভাষায়। সেই ভাষাতেই সে শিক্ষার চর্চা করে। সুতরাং সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজভাবনা, বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসারে মাতৃভাষা অবশ্যই একটি বিশেষ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে।

মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সমস্যা

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যার কথা অবশ্য অস্বীকার করা যায় না। কারণ-

(১) বিশ্বে প্রতিনিয়তই জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তাভাবনায় উত্থান পতন ঘটে যাচ্ছে। সেগুলো প্রকাশিত হয় ইংরেজির মতো নানান প্রধান বিদেশি ভাষায়। শুধুমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করলে সেসব জানা সম্ভব হয় না।

(২) শিল্প-কলা-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক শব্দের পারিভাষিক শব্দ মাতৃভাষার দ্বারা বোধগম্য হয় না।

(৩) ভারতের মতো বহু ভাষাভাষীর দেশের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান হলে দেশের অপর ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা প্রায় ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সমস্যা সমাধানের উপায়

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা অবশ্যই আছে। তবে তার সমাধানও রয়েছে। সেই সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে বলা যায়-মাতৃভাষাকে শিক্ষাদানের প্রধান মাধ্যম হিসেবে রেখে ইংরেজির মতো বিশ্বজনীন একটি বিদেশি ভাষাকে এবং দেশের একটি প্রধান ভাষাকে শিক্ষার দ্বিতীয় মাধ্যম করা যেতে পারে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সেই দুটি ভাষা হতে পারে ইংরেজি এবং হিন্দি।

বঙ্গদেশে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব

বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠাকালে বাংলা ভাষা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। তখন শিক্ষার মাধ্যম হয়ে ওঠে ইংরেজি ভাষা। এই অবস্থায় হাল ধরেন রাজা রামমোহন রায় থেকে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেকেই। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় সরকারি স্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের কথা ঘোষণা করেন। স্বাভাবিকভাবে বঙ্গদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই ব্যাপারে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে গিয়েছে বর্তমানের বাংলাদেশ।

উপসংহার

অতীতে না হলেও আজকের দিনে মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছে মানুষজন। UNESCO স্পষ্টতই ঘোষণা করেছে, ‘The best medium for teaching is the mother tongue of the pupil’। এই যে দুঃখের কথা, মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, ভারতবর্ষের সব রাজ্য এখনও সেই গুরুত্ব দিয়ে উঠতে পারেননি। তবে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে সেই সমস্যাও দূর হবে।

Leave a Comment