মনীষীদের জীবনীপাঠের উপযোগিতা রচনা

মনীষীদের জীবনীপাঠের উপযোগিতা রচনা
মনীষীদের জীবনীপাঠের উপযোগিতা রচনা

ভূমিকা

‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র প্রশ্ন করেছিলেন ‘এ জীবন লইয়া কি করিব? কি করিতে হয়?’ জীবভাবের ঊর্ধ্বে ওঠা সকল মানুষের এই আত্মজিজ্ঞাসার উত্তরে বলা যায়-

“মহাজ্ঞানী মহাজন           যে পথে করে গমন 
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়।

সেই পথ লক্ষ্য করে           স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে 

আমরাও হব বরণীয়।।”

মহাপুরুষগণ নির্দেশিত পথ ও মতে চললে জীবনের বিচিত্র কর্মক্ষেত্রে আমরা বিপুল সাহস ও উদ্দীপনা, দুঃখজয়ের অসীম সাহস অর্জন করি। ‘জীবনচরিত’ বা ‘জীবনী’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি সমন্বিত গ্রন্থ। তাই মনীষীদের জীবনী পাঠ করা মানে কেবল জীবনের ঘটনাবলি পাঠ নয়, ওই ঘটনাবলিকে ঘিরে মহাপ্রাণ ব্যক্তির মহৎ কাজের মধ্যে প্রকাশিত মানবিক আদর্শের শিক্ষাগ্রহণ।

নতুন জীবনবোধ

গান্ধিজি বলেছেন-‘My life is my message’। মহাপুরুষদের জীবনই বাণী, তাই মনীষীদের জীবনীপাঠ করলে এমন বাণীর সন্ধান পাওয়া যায়, যা জীবনকে দেবে নতুন অর্থ। মহাপুরুষদের জীবনীপাঠ যেন নতুন, উন্নত জীবনবোধেরই নামান্তর।

দিকনির্ণয় যন্ত্রস্বরূপ

আমরা জীবনসমুদ্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে যখন দিশাহারা হয়ে পড়ি তখন মহাপুরুষদের জীবনী আলোকস্তম্ভের মতো আমাদের পথ দেখাতে পারে। তাঁদের জীবনীপাঠ আর্ত ও পীড়িত মানুষকে সত্য ও মঙ্গলের ধ্রুব লক্ষ্যপথে পরিচালিত করে।

সঞ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষা

হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর মানুষকে অহিংসা, প্রেম-মৈত্রীর সঞ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারে মনীষীদের জীবনীপাঠ; তাঁদের জীবনের মহৎ আদর্শ, ত্যাগ, তিতিক্ষার নিদর্শন। তাই বলা যায়-

“তারা বলে গেল ক্ষমা করো সবে
বলে গেল ভালোবাসো
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।”

পথ চলার প্রেরণা

মনীষীরা কল্যাণব্রতের যে অবদান রেখে গিয়েছেন জীবনীপাঠের মধ্য দিয়ে আমরা তার সঙ্গে পরিচিত হই ও অন্ধকারে পথ চলার প্রেরণা পাই। তাই জীবনীগ্রন্থ হল-Friend, Philosopher and guide.

স্পর্শমণির ছোঁয়া

স্বার্থবুদ্ধি আর সংকীর্ণ কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত করে আমাদের আবার অমৃতের সন্তানরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে মনীষীদের জীবনী। তাঁদের স্পর্শমণির ছোঁয়ায় আমরাও উঠি সোনা হয়ে। জীবনীপাঠের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, সত্যকে আবিষ্কার করে জীবনীপাঠের মধ্য দিয়ে লাভ করে পরমানন্দের উপলব্ধি।

জীবনীগ্রন্থের বৈচিত্র্য

সাধারণ মানুষে মানুষে যেমন বৈচিত্র্য বৈষম্য আছে মনীষীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। একদিকে আমরা পাই জিশু, মহম্মদ, চৈতন্য, নানক, শ্রীরামকৃষ্ণের মতো ধর্মগুরুদের অন্যদিকে পাই রানাপ্রতাপ, গ্যারিবল্ডি, নেপোলিয়ন, নেতাজির মতো দেশপ্রেমিকদের। এইভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, আর্তের ত্রাণে, শিল্প-সাহিত্যে যাঁরা বিশ্বমানবকে নতুন জীবনবোধের সন্ধান দিয়েছেন তাঁদের জীবনীও -পাঠ্য। যারা যে পথের পথিক, যে রসের রসিক তারা তাদের ঈপ্সিত পথের নির্দেশ খুঁজে নেবে এইসব গ্রন্থের মাধ্যমে। 

অনুসূতির প্রয়াস

জীবনীপাঠ মানে যে ব্যক্তির জীবনীপাঠ করা হচ্ছে, তাঁকে পাঠকের নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনার ঊর্ধ্বে বসিয়ে তাঁর মতাদর্শের অন্ধ অনুকরণ নয়। পাঠক যদি সজাগচিত্তে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেই মহান ব্যক্তির জীবনাদর্শকে অনুধাবন ও গ্রহণ করতে পারে, তাই হবে জীবনীপাঠের প্রকৃত তাৎপর্য ও চর্চা। –

উপসংহার

মনীষীদের জীবনীপাঠের ভিতর দিয়ে আমাদের নবজন্ম হয়, বিকশিত হয় চিত্তশতদল। পাপ, ভ্রান্তি, ক্ষুদ্রতা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে অজেয় শক্তি অর্জন করি আমরা ও নিজ নিজ ব্রতসাধনে হই দৃঢ়চিত্ত। ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে ছাত্রজীবনে মনীষীদের জীবনীপাঠ অপরিহার্য হওয়া প্রয়োজন। মহৎ যদি আমরা নাও হতে পারি, মহতের প্রতি যাত্রাই আমাদের মনুষ্যত্বকে ধরে রাখতে পারবে। কবির ভাষায় বলা যায়-

“এসো মহাজন করি আলাপন 
বসো হে হৃদয় পরে 
মিথ চা শিখাও আমারে ত্যাগিব কেমনে

বিশ্বমানব তরে।”

Leave a Comment