ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫ খ্রি. Congress of Vienna) সম্পর্কে আলোচনা করো। |
নেপোলিয়নের পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে এক সম্মেলনে সমবেত হন। এই সম্মেলন চলেছিল ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর থেকে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাস পর্যন্ত। একে ভিয়েনা সম্মেলন বলা হয়। পোপ ও তুরস্কের সুলতান ছাড়া ইউরোপের সব দেশের রাষ্ট্রনেতারা সম্মেলনে যোগ দেন। এই সম্মেলন ছিল ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত নীতি
ভিয়েনা সম্মেলনে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর তিনটি নীতি গ্রহণ করা হয়। এই তিনটি নীতি হল- ① ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy), ② ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation) ও শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power)।
এই নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে সম্মেলনের কার্যকলাপ পরিচালিত হয়।
ন্যায্য অধিকার নীতি (Principle of Legitimacy)
ন্যায্য অধিকার নীতিতে বলা হয়, ফরাসি বিপ্লবের আগে যে রাজা বা রাজবংশ যে দেশে রাজত্ব করতেন, সেখানে সেই রাজার বা রাজবংশের আবার রাজত্ব করার অধিকার আছে। এই নীতি অনুসারে–
- ফ্রান্সে বুরবো বংশের শাসক অস্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন।
- স্পেন, সিসিলি ও নেপলসেও বুরবো বংশের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
- অস্ট্রিয়ায় হ্যাপসবার্গ বংশ তাদের রাজত্ব ফিরে পায়।
- হল্যান্ডে অরেঞ্জ বংশ এবং স্যাভয়, জেনোয়া, পিডমন্ট ও সার্ভিনিয়ায় স্যাভয় বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ক্ষতিপূরণ নীতি (Principle of Compensation)
নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভিয়েনা সম্মেলনে তারা নিজেদের ক্ষতিপূরণ করে নেওয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ‘ক্ষতিপূরণ নীতি’ নামে পরিচিত।
যেসব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেগুলি হল- ইংল্যান্ড, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি। ক্ষতিপূরণ নীতি অনুসারে এই দেশগুলি যেভাবে উপকৃত হয়, তা নিম্নরূপ-
অস্ট্রিয়া: অস্ট্রিয়া উত্তর ইটালিতে পায় লম্বার্ডি, ভেনেসিয়া, টাইরল প্রভৃতি প্রদেশ। মধ্য ইটালিতে পার্মা, মডেনা ও টাসকানির উপর অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ট্রিয়া নবগঠিত জার্মান কনফেডারেশনের সভাপতির পদ লাভ করে।
রাশিয়া: রাশিয়া পায় পোল্যান্ডের বৃহদংশ, ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাভিয়া।
রাশিয়া: রাশিয়া পায় পোল্যান্ডের বৃহদংশ, ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাভিয়া।
প্রাশিয়া: প্রাশিয়া পায় স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, পশ্চিম পোমেরানিয়া ও রাইন নদীর বাম তীরবর্তী অঞ্চল।
ইংল্যান্ড: ইংল্যান্ড ঔপনিবেশিক স্বার্থে ক্ষতিপূরণ হিসেবে নেয় ভূমধ্যসাগরের মাল্টা দ্বীপ, মরিসাস, হেলিগোল্যান্ড, সিংহল প্রভৃতি।
শক্তিসাম্য নীতি (Principle of Balance of Power)
ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত শক্তিসামা নীতি বলতে বোঝায় ফ্রান্সের শক্তি খর্ব করে সমতা তৈরি করা, ফ্রান্স যাতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। এই নীতি অনুসারে-
- ফ্রান্সকে বিপ্লব পূর্ববর্তী সীমানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
- ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। ৫ বছরের জন্য ফ্রান্সে মিত্রপক্ষের সেনা মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
- মিত্রপক্ষের এই সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার ফ্রান্সকে বহন করতে হয়।
- মিত্রপক্ষকে ৭০ কোটি ফ্রাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দিতে ফ্রান্সকে বাধ্য করা হয়।
- ফ্রান্সের চারপাশে শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়।
- ফ্রান্সের পূর্বসীমান্তে রাইন অঞ্চলকে প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে লুক্সেমবুর্গ ও বেলজিয়ামকে হল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
- ফ্রান্সের দক্ষিণে স্যাভয় ও জেনোয়াকে সার্ভিনিয়ার সঙ্গে এবং ফ্রান্সের দক্ষিণ-পূর্বে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কয়েকটি অঞ্চল যুক্ত করা হয়। সুইজারল্যান্ডকে নিরপেক্ষ দেশ’ বলে ঘোষণা করা হয়।
ভিয়েনা সম্মেলনের নীতি ও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ
ভিয়েনা সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ ন্যায্য অধিকার ও ক্ষতিপূরণ নীতি প্রয়োগ কবে ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত জাতীয়তাবাদের চরম অবমাননা করেছিলেন। জার্মানি ও ইটালির রাজ্যগুলিকে ঐক্যবন্ধ জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত না করে পুনরায় স্বৈরতন্ত্রী অস্ট্রিয়া বা প্রাশিয়ার অধীনে স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া শক্তিসাম্য নীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে সম্মেলনের আয়োজকরা ফরাসি বিপ্লবপ্রসূত ভাবাদর্শকে বিসর্জন দিয়েছিলেন।