বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসব পালনের অভিজ্ঞতা রচনা |
ভূমিকা
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’ নাগরিক সভ্যতার বিষবাষ্পে কবি রুদ্ধশ্বাস হয়ে এ কথা উল্লেখ করেছিলেন। যান্ত্রিক সভ্যতা ও নাগরিক জীবনের বিরুদ্ধে মুক্ত অরণ্যসভ্যতার আবেদন এখানে ধ্বনিত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে পা দিয়েও আমাদের অন্তরে ঘন সবুজ এক পৃথিবী পাওয়ার অকৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে রয়েছে। গাছপালাহীন জীবন আজ নানা ব্যাধিতে জর্জরিত। তাই আজ বিশ্ব জুড়ে বনমহোৎসব বা বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন আবশ্যিক।
প্রয়োজনীয়তা
সৃষ্টির আদিমলগ্নে স্থলভাগের অধিকাংশ স্থান জুড়ে ছিল নিবিড় বনভূমি। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেই শ্বাপদসংকুল বনভূমি উচ্ছেদ করে বাসস্থানের প্রয়োজনে গড়তে শুরু করল জনপদ। আদিম মানুষের দল বনভূমি নির্মূল করে তৈরি করল শস্যভূমি। ক্রমে ক্রমে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে আজ বনভূমি নিশ্চিহ্নপ্রায়। অথচ বনভূমি মানবজীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য, যা প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। এর উপর নির্ভর করে সুষম বৃষ্টিপাত, রোধ হয় ভূমিক্ষয়। শুধু তাই নয়, বনভূমি সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে জীবনকে রক্ষা করে, পরোক্ষে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সহায়ক হয়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বৃক্ষরোপণ একদিকে প্রকৃতিজীবনের নিয়ন্ত্রক অন্যদিকে মানবজীবনের রক্ষক।
আমার বিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসব
সম্প্রতি আমার বিদ্যালয় সালকিয়া এএস হাই স্কুলে বৃক্ষরোপণ উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে প্রতিবেশী বিদ্যালয়গুলির ছাত্রছাত্রীদের আমাদের বিদ্যালয়সংলগ্ন মাঠে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় শিক্ষক ও শিক্ষিকারা। স্থানীয় পুরসভা থেকে নানারকম বৃক্ষের চারা দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত থেকে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা করেন ও বক্তব্য রাখেন। বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকারা। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ছাত্রছাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে বৃক্ষরোপণ করে। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও প্রাচীরের সীমানায় লাগানো হয় শিশু, কদম, পেয়ারা, আম ইত্যাদি গাছের চারা। গাছের গোড়ায় দেওয়া হয় পরিমাণমতো মাটি, সার, জল। তারপর একটি বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় চারা গাছগুলির চারধার। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকরা বিদ্যালয়প্রাঙ্গণ ঘুরে ঘুরে নবরোপিত চারাগাছগুলি পরিদর্শন করেন। অনুষ্ঠানের সকল বক্তাই বোঝান যে, একদিন বৃক্ষরোপণ করেই ছাত্রছাত্রীদের কাজ শেষ হয়ে গেল না বরং তাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। প্রতিদিনই তাদের গাছগুলিকে পরিচর্যা করতে হবে। তাদের আজকের পরিশ্রম সার্থক হবে যখন গাছগুলি আগামী দিনে বড়ো হয়ে উঠবে।
উৎসবের অঙ্গীকার
বনাঞ্চল বিপন্ন। দেশ জুড়ে নির্মূল হচ্ছে অরণ্য। এমনকি এক-একটি শহর পরিণত হচ্ছে বৃক্ষলতার স্পর্শহীন পাষাণপুরীতে। যার ফলে সভ্যতাগবী মানুষের জীবন জটিল সমস্যায় আক্রান্ত। এজন্য সারাদেশে বৃক্ষরোপণ ও বনমহোৎসব পালন আজ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ১৪ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ উৎসব সরকারিভাবে পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকারি উদ্যোগে এই উৎসব পালন করা শুরু হয়েছে। সরকারি কৃষি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় ছায়াদায়ী দীর্ঘজীবী চারারোপণ করা হচ্ছে। বিদ্যালয়স্তরে এই উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে যে, ‘একটি গাছ একটি প্রাণ’-এই বাণীকে আমরা যেন বাস্তবায়িত করতে পারি।
উপসংহার
বৃক্ষরোপণ আজ জাতীয় কর্তব্য। আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার জন্য সেইসব গাছ লাগাতে হবে, যা প্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করবে। তবু বলতে হয় বৃক্ষরোপণ বা বনসংরক্ষণের জন্য বনমহোৎসব জাতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান যথেষ্ট নয়। এজন্য সর্বাগ্রে চাই জাতীয় সচেতনতা। ‘বৃক্ষ আমাদের জীবন’-এই স্লোগান বা এই বোধটুকু মানুষের মনে সবথেকে ভালোভাবে সঞ্চারিত করতে পারে ছাত্রছাত্রীরাই। কারণ তারাই দেশের ভবিষ্যৎ বা ভাবী নাগরিক। তাদের প্রচেষ্টাতেই পৃথিবী আবার একদিন সম্পূর্ণ দূষণহীন হয়ে উঠবে।