বিজ্ঞাপন ও আধুনিক সমাজ রচনা |
ভূমিকা
আধুনিক জীবনে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব ও মহিমা অপরিসীম। সংবাদপত্র, দূরদর্শনের পর্দা, পোস্টার, রেডিয়ো, হোর্ডিং, হ্যান্ডবিল, মাইক্রোফোন ইত্যাদি কত মাধ্যমের দ্বারা কতভাবেই না বিজ্ঞাপনী প্রচার আমরা আজকাল নিত্যই দেখতে অভ্যস্ত। এখন প্রশ্ন হল বিজ্ঞাপন আসলে কী? ‘বিজ্ঞাপন’ কথাটির পারিভাষিক অর্থ হল বিশেষভাবে – জ্ঞাপন করা। বিজ্ঞাপন হল উৎপাদক বা বিক্রেতার তরফ থেকে জনসাধারণের অবগতির জন্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত বিবরণ বা ইস্তাহার।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সারা পৃথিবী জুড়ে যখন বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হয়, তখন থেকেই বিজ্ঞাপন আমাদের সামাজিক জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। মনে রাখা প্রয়োজন বিজ্ঞাপনের পিছনে প্রায়শই থাকে বাণিজ্যিক লক্ষ্য। কোনো বিশেষ পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করাই হয়ে দাঁড়ায় বিজ্ঞাপনদাতাদের অভিপ্রায়। তবে শুধু ভোগ্যপণ্য কেন-শিক্ষা, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এমনকি রাজনৈতিক প্রচার আবার জনসচেতনতামূলক ঘোষণাও আজকাল বিজ্ঞাপনের দ্বারা সম্পন্ন হয়।
বিজ্ঞাপনের স্বরূপ
আজকের পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা প্রচারিত হয়। সর্বশ্রেণির ক্রেতা ও উপভোক্তা বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রভাবিত। রাস্তার ধারে, যানবাহনে, বাড়ির দেয়ালে, সংবাদপত্রে, সাময়িকপত্রে, প্রচারপত্রে, সাইনবোর্ডে, দেয়াললিখনে, দূরদর্শনে-সর্বত্রই বিজ্ঞাপনের ঝলমলে ছবি, যা চোখকে আকৃষ্ট করে আবার কখনো মনকেও স্পর্শ করে যায়। বিজ্ঞাপনের প্রয়োগ যত বেশি চিত্তাকর্ষক হয়, তত বেশি মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে।
বিজ্ঞাপনের চোখধাঁধানো জগৎ
সুন্দরের প্রতি, শিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরদিনের। তাই প্রত্যেক বিজ্ঞাপনদাতাই তাদের উৎপাদিত দ্রব্যকে শ্রীমণ্ডিত রূপ দান করতে চান। তাতে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। শিল্পনির্দেশক এবং ফোটোগ্রাফারের দক্ষতায় সুন্দরী মডেলদের মনোলোভা হাসি যখন কোনো পণ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়, তখন সেই পণ্যের আকর্ষণও হয়ে ওঠে সেই মডেলের সৌন্দর্যের মতোই অমোঘ। এভাবেই শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের প্রভাবে অনেক সময় পণ্যের প্রকৃত গুণাগুণ ও প্রয়োজনীয়তা বিচার না করে বিজ্ঞাপিত পণ্য ক্রয় করেন উপভোক্তারা। এমন অনেক দ্রব্য আছে যেগুলি কেবল বিজ্ঞাপনের সুবাদেই বিক্রয়যোগ্য হয়ে ওঠে। ক্রেতাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই এইসব দ্রব্যের প্রকৃত কোনো চাহিদা থাকে না।
বিজ্ঞাপনের চমকে বিভ্রান্ত মানবসমাজ
বিজ্ঞাপন সাধারণত মানুষের প্রবৃত্তিকে কোনো-না-কোনো উপায়ে নাড়া দেয়। বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষের চেতনাকে প্রভাবিত করে বিজ্ঞাপিত পণ্যটির চাহিদা এবং বিক্রি বাড়ানো। বিজ্ঞাপনের জৌলুসে ভুলে মানুষ এমন অনেক দ্রব্য ক্রয় করে, যা তার কাছে অত্যাবশ্যক নয়। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে অর্থের অপচয় ঘটে থাকে। এই অর্থের অপব্যয় অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। তাই বুদ্ধিমান ক্রেতা হিসেবে আমাদের কর্তব্য হল, কেবল চটকদার বিজ্ঞাপনের দ্বারা প্রলোভিত হয়ে কোনো দ্রব্য ক্রয় না করে চিন্তাভাবনা করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যই ক্রয় করা।
বিজ্ঞাপনের ভালোমন্দ
আজকের অত্যাধুনিক যুগে সারা বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত নিত্যনতুন পণ্যসম্ভারের খোঁজখবর পাওয়ার প্রশস্ত উপায় বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনই আমাদের জানতে সাহায্য করে পড়াশোনা সম্পর্কিত তথ্যাদি, খেলাধুলা, হালফিলের চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত, সাহিত্য ইত্যাদির খবর। এর মাধ্যমে বহু মানুষের পেশার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়। বর্তমানে যে-কোনো উৎসবের জাঁকজমক ও ব্যাপ্তি বিজ্ঞাপনের দৌলতে অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গণচেতনা তৈরি করতে বা জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেও অন্যতম ভূমিকা পালন করে বিজ্ঞাপন। এসবই বিজ্ঞাপনের ইতিবাচক দিক।
কিন্তু বিজ্ঞাপনের নেতিবাচক দিকও আছে। প্রথমত বিজ্ঞাপন অনেক সময়েই বিজ্ঞাপিত বস্তু বা বিষয়টি সম্বন্ধে উপভোক্তার মনে মিথ্যে বা ভুল ধারণার ইন্ধন জোগায়। বিজ্ঞাপনের উপর প্রত্যেক দেশের নিজস্ব আইনানুগ বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও বহুক্ষেত্রে অশ্লীলতা বা বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটে বিজ্ঞাপনে, যা জনমানসের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞাপনের নিত্যনতুন চমক মানবমনে অতৃপ্তির সঞ্চারে অস্বাভাবিক বাসনার ঝড় তোলে, মূল্যবোধকে বিকৃত করে তোলে। বিজ্ঞাপনের কুপ্রভাব থেকে দরকার মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় ও আইনি ব্যবস্থাগুলির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।