বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতা প্রবন্ধ রচনা |
ভূমিকা
আগুন আবিষ্কারের ভিতর দিয়েই পথচলা শুরু হয়েছিল বিজ্ঞানের। দীর্ঘ পথ পার করে সেই বিজ্ঞানই আজকের দিনে হয়ে উঠেছে মানবসভ্যতার এক অপরিহার্য সঙ্গী। বিজ্ঞানের বিশেষ ভূমিকার কথা মেনে নিয়ে প্রখ্যাত এক বাঙালি বিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন-
বিজ্ঞান থেকে সার্বিক সুবিধা পেতে গেলে অবশ্য মানুষকে আগে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে।
বিজ্ঞান কাকে বলে
সামগ্রিক অর্থে বিজ্ঞান হল এমন একটি বিশেষ জ্ঞান, যা যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রমাণ, বিশ্লেষণ এবং প্রয়োগ নির্ভর। খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এমার্সন আবার বলেছেন-
এসব ছাড়াও বলা যায়-এই বিশেষ জ্ঞানের প্রসারে এবং ব্যবহারিক প্রয়োগে জীবন হয়ে ওঠে উন্নত, সেক্ষেত্রে মানবসভ্যতারও বিপুল অগ্রগতি ঘটে।
বিজ্ঞানমনস্কতা কাকে বলে
বিজ্ঞানমনস্কতার সাধারণ অর্থ হল বিজ্ঞানবোধ বা বিজ্ঞানচেতনা। দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানপাঠ ও অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষের মধ্যে এই বোধ গড়ে ওঠে। সুতরাং সবদিক বিচার করে বলা যায়- দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানপাঠ ও বিজ্ঞানচর্চার ভিতর দিয়ে বিজ্ঞানের মতো যুক্তি, প্রমাণ, বিশ্লেষণ এবং প্রয়োগ-পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো বিষয়, ঘটনা, প্রথা, আচরণ ইত্যাদিকে যাচাই বা বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে মানসিকতা জন্মায়, তাকেই বলা হয় বিজ্ঞানমনস্কতা বা বিজ্ঞানচেতনা।
বিজ্ঞনমনস্কতার বৈশিষ্ট্য
বিজ্ঞানমনস্কতার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন- (১) এই ধরনের মানসিকতায় সবকিছুকে যুক্তির আলোকে বিচার করা হয়। (২) বাস্তব সত্যই এই মানসিকতায় একমাত্র সত্য। (৩) বিজ্ঞানমনস্কতায় বিশ্লেষণকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। (৪) এই মানসিকতার মানুষ বিজ্ঞানভাবনাজনিত আত্মশক্তিতে বলিয়ান বলে প্রচলিত বা অলৌকিককেও একবাক্যে মেনে নেয় না।
বিজ্ঞানমনস্কতার প্রয়োজন কেন
প্রাচীন থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বিজ্ঞান তার জয়যাত্রা অপ্রতিহতভাবেই বজায় রেখেছে। এই জয়যাত্রায় সে তার যাবতীয় সম্ভার তথা যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিয়েছে মানুষের দোরগোড়ায়। কিন্তু আজও পর্যন্ত বিজ্ঞানের সুবিধা পাওয়া মানুষজনদের সবাই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠেনি। আজও-
- (ক) প্রচলিত প্রথা, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মের অনুশাসন, লৌকিক বিশ্বাস ইত্যাদিকে যুক্তি, প্রমাণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচার করে না মানুষজন।
- (খ) সমাজে প্রচলিত জাতপাত, নানান অন্ধবিশ্বাস, বর্ণবৈষম্য, অলৌকিক কোনো ঘটনার মধ্যে যে প্রকৃত সত্য নেই, তা ভেবে দেখে না অনেকেই। যুক্তি দ্বারা বিচার না করেই মেনে নেয়।
এই অবস্থায় যাবতীয় অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে পারে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার। সেদিক দিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা শুধু একালেই নয়, সব কালেই একান্ত প্রয়োজনীয়।
বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধির উপায়
প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, ধর্মাচরণ, বর্ণবৈষম্য, জাতপাত, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ইত্যাদি কিছু মানুষের মনে এমনভাবে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে যে, সেগুলোকে উপড়ে ফেলে সবাইকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা খুব সহজসাধ্য নয়। তার জন্য প্রয়োজন- (১) বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি সার্বিক শিক্ষারও প্রসার ঘটানো। (২) সমাজের সর্বত্র আধুনিকতার স্পর্শ পৌঁছে দিতে হবে। তাতে মানুষের মনের অন্ধকার কিছুটা হলেও ঘুচবে। (৩) দারিদ্র্যদূরীকরণ না হলে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার এক শ্রেণির মানুষের মধ্য সম্ভব নয়। কেননা তাদের কাছে-‘ঘরেতে অভাব পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া’ (সুকান্ত ভট্টাচার্য)। সেকারণে সর্বাগ্রে দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রয়োজন। (৪) নানান ধরনের নাটক, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞানমঞ্চ ও বিজ্ঞানজাঠার মাধ্যমে বিজ্ঞানমস্কতা বাড়ানোর চেষ্টা ফলদায়ক হতে পারে।
বিজ্ঞানমনস্কতার বিশেষ অন্তরায়
বিজ্ঞানমনস্কতা বৃদ্ধির পথে বিশেষ একটি অন্তরায় হল মানুষের মনে গেঁথে থাকা কুসংস্কার। এই কুসংস্কারের উৎস সম্পর্কে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন- ‘It is the undefined source of fear and hope which is the genesis of irrational superstition.’ এর পাশাপাশি অন্ধবিশ্বাস, মনের ভিতরে থাকা ‘কী থেকে কী হবে’-গোছের ভয়, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, প্রচলিতকে আঁকড়ে থাকার মানসিকতাও বিজ্ঞান মনস্কতার বিশেষ অন্তরায়।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে দেশের সরকারও তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তা ছাড়া বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের সময় মনে রাখতে হবে আইনস্টাইনের সেই উক্তি ‘Religion without science is lame, science without religion is dead.’ সুতরাং দেশের ঐতিহ্য, দেশের মানুষের প্রকৃত ধর্মবৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রেখে এবং বিশ্লেষণী যুক্তিবাদকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচেষ্টা চালালে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়াবার ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে পারে।
আরও পড়ুন – 1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ গুলি কী ছিল