বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা – বিজ্ঞান যেহেতু সমস্ত কিছু যুক্তি ও কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, তাই তার সঙ্গে কুসংস্কারের বিরোধ অনিবার্য। এ কারণেই বিজ্ঞান ও কুসংস্কার শব্দ দুটি যেন পরস্পর বিপরীত এবং দ্বন্দুময়।
তো চলুন আজকের মূল বিষয় বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা পড়ে নেওয়া যাক।
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা |
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা
ভূমিকা
সংস্কার শব্দের আভিধানিক অর্থ শুদ্ধি বা শোধন। কিন্তু প্রচলিত ধারণা, বিশ্বাস, রীতি, আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে যখন অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাস বাসা বাঁধে, তখন তাকে বলে কুসংস্কার। বিজ্ঞানের এই চরমতম সাফল্যের যুগে মানবসভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক, সভ্যতার পথে বিজ্ঞান ও কুসংস্কার সমান্তরালভাবে চলেছে। বিজ্ঞান যেহেতু সমস্ত কিছু যুক্তি ও কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, তাই তার সঙ্গে কুসংস্কারের বিরোধ অনিবার্য। এ কারণেই বিজ্ঞান ও কুসংস্কার শব্দ দুটি যেন পরস্পর বিপরীত এবং দ্বন্দুময়।
বিজ্ঞানমনস্কতা
বিজ্ঞানের ব্যাবহারিক ও প্রযুক্তিগত দিকের পাশাপাশি একটি তাত্ত্বিক দিক আছে। এই দিকটি সম্পূর্ণত চিন্তা, অন্বেষণ ও অনুধ্যানের দিক। চারপাশের সমস্ত কিছুকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করাই হল বিজ্ঞানমনস্কতার মূল দিক।
কুসংস্কার
কুসংস্কার হল মানুষের এমন এক অন্ধবিশ্বাস যেখানে যুক্তির কোনো স্থান নেই। মানুষের অজানার প্রতি আকর্ষণ যেমন চিরকালীন, তেমনই তার চেতনালোকের অতীত বিষয়গুলি সম্পর্কে রয়েছে এক অদ্ভুত ভীতি। সেই ভয় থেকে পরিত্রাণ পেতেই মানুষ কিছু অন্ধবিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। যুক্তিবোধের সম্পূর্ণ বিপরীতে থাকা এই বিশ্বাসই হল কুসংস্কার।
কুসংস্কারের সূচনা
অরণ্যচারী বা গুহাবাসী মানুষ ছিল প্রকৃতির হাতের পুতুল। তারা তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের মূল কারণ অনুধাবন করতে না পেরে ভূতপ্রেত বা অপদেবতার চোখরাঙানিকে দায়ী করত। এ কারণে তাদেরকে তুষ্ট করার জন্য শুরু হয়েছিল অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড আর তখনই সূচনা হয় কুসংস্কার নামক অভিশপ্ত লোকাচারটির। বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল মানুষের আগুন জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। মানুষ তখন থেকেই প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন ব্যাবহারিক বস্তু আবিষ্কার করতে শিখল। ক্রমে ক্রমে গবেষণা, পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হতে থাকে। এরপর থেকেই মানুষ নিজেদেরকে বাঁচানোর উপায় উদ্ভাবন করতে থাকে, যা বিজ্ঞানের জয়যাত্রার নিদর্শন।
বিভিন্ন কুসংস্কার
কুসংস্কার এমন একটা বিশ্বাস যার পিছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। আমাদের দেশে যাত্রাকালে হাঁচি, পিছন থেকে ডাকা, বারবেলা, শূন্য কলশি দেখা প্রভৃতি নানা কিছু অমঙ্গলসূচক বলে বিশ্বাস করা হয়। সর্পদষ্ট ব্যক্তি, হিস্টিরিয়া রোগীর চিকিৎসা করানো হয় ওঝার ঝাড়ফুঁক দিয়ে, যা রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। ‘ডাইন’ অপবাদে চিহ্নিত করে আদিবাসী রমণীকে খুন করা হয় কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে। শহরে শিক্ষিত মানুষেরাও বিশ্বাস করে গণেশ ঠাকুরের মূর্তির দুধ খাওয়ার বুজরুকিতে, গ্রহরত্ন, মাদুলি, কবচের গুণাগুণে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও কুসংস্কার কম নয়-অশশীভ তেরো সংখ্যা, বিভিন্ন অশুভ দিন, অশুভ ও অমঙ্গলকারী বলে চিহ্নিত পশুপাখি তাদের জীবনচর্যাতেও প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে এখনও।
বিজ্ঞানশিক্ষার লক্ষ্য
যুগযুগান্তর ধরে জনমানসে স্থান করে নেওয়া কুসংস্কার সহজে বিলুপ্ত হওয়ার নয়। তাই বিখ্যাত শল্যচিকিৎসকও অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করে নেন। অনেক বৈজ্ঞানিকই ধারণ করেন গ্রহরত্ন। বিজ্ঞানের ছাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানে কিন্তু অনেকসময়ই যথার্থ বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে যুক্তিবাহিত অন্য কোনো বিশ্বাসে আশ্রয় খোঁজে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কেতাবি শিক্ষা শুধু নয়, তার বাইরেও শিক্ষার্থীকে জীবনের সবক্ষেত্রে কার্যকারণ সূত্র খুঁজতে শেখানোই বৈজ্ঞানিক শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
“যে জাতি জীবনহারা অচল, অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।”
কুসংস্কারের প্রতিবিধান
কুসংস্কারের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে দরকার প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ও বিজ্ঞানচেতনার যথাযথ বিস্তার। বিজ্ঞানই পারে কুসংস্কারকে বিনাশ করতে। আর যেখানে নিরক্ষরতা সেখানেই ধর্মান্ধতা ও অন্ধবিশ্বাসের রাজত্ব। সমাজের সবস্তরের মানুষের মধ্যে যদি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে মানুষের মনের অন্ধকার ঘুচে যাবে।
উপসংহার
কুসংস্কারের মূলে রয়েছে মানুষের বিপন্নতা, অসহায়তা। কারণ, ‘There are many things in earth and heaven Horatio, that are not in your dictionary.’ তাই এই বিশাল ব্যপ্ত পৃথিবীর অজানার প্রতি যেমন তার রয়েছে দুর্বার আকর্ষণ তেমনই সেই অজ্ঞাতলোকের জন্য রয়েছে ভয়। সেই ভয় থেকেই শুরু হয় অশুভকে এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা। তার থেকেই মনের কোণে বাসা বাঁধে কুসংস্কার। মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হলে তবেই কুসংস্কারের বিনাশ সম্ভব। তাই আমাদের সমবেত প্রয়াসে কুসংস্কার সমূলে উচ্ছেদ করে সভ্যতাকে সুন্দর করে তুলতে হবে।
আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।