|
বাংলার উৎসব রচনা
|
ভূমিকা
“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী-কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।”
ঋতুর বর্ণময় আবর্তনের সঙ্গে বাঙালির মানসিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের নিবিড়, অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। তারই সঙ্গে সম্পৃক্ত বাঙালির উৎসবপ্রীতির মেলবন্ধনের ফলস্বরূপ বাংলায় রকমারি • উৎসবের ঘটা। ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’-এই প্রবাদটিকে প্রকৃত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অল্প-ভাষণই বলা যায়।
উৎস
বৈদিক সাহিত্যের অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে ‘উৎসব’ হল বৈদিক ঋষিদের ‘সোমরস’ নিষ্কাশনের এক আনন্দময় আচার-অনুষ্ঠান। ঋগ্বেদের ‘সমন’ শব্দ উৎসববাচক। তবে আরও • পিছিয়ে গেলে আদিম শিকারি মানুষের ‘সমষ্টি ভোজ’-কে উৎসবের রূপ • হিসেবে ধরা যেতে পারে। কালক্রমে উৎসব বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের বৈচিত্র্য ও ব্যাপকতা অর্জন করেছে। নানাবিধ প্রাকৃতিক ব্যাপার, বারব্রত, সংস্কার, লোকাচার, পূজাপার্বণ তো আছেই, তা ছাড়াও মনীষী মহাপুরুষদের জন্মমৃত্যু, ইতিহাসপ্রসিদ্ধ দিন এবং আরও নানাবিধ সামাজিক ব্যাপার সমাগত হয়েছে বাংলার উৎসবের ক্ষেত্রে।
উৎসবের শ্রেণিবিভাগ
বাংলার বৈচিত্র্যপূর্ণ উৎসবের সমারোহকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে-
(ক) বৈদিক উৎসব : নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, আভ্যুদায়িক বা ঋষিশ্রাদ্ধ, পার্বণশ্রাদ্ধ ইত্যাদি।
(খ) পৌরাণিক (শাস্ত্রীয়) উৎসব: নাম মহোৎসব, সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর উৎসব, সরস্বতী, চণ্ডী, মনসা, ধর্মদেবতা বিষয়ক উৎসব, কৃম্নজন্মোৎসব বা জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা, দোলযাত্রা ও রাসযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাধাষ্টমী, কোজাগরি লক্ষ্মীপূজা, শিবরাত্রি, দুর্গোৎসব, জগদ্ধাত্রীপূজা, কালীপূজা, দীপাবলি, কার্তিকপূজা, বড়োদিন, গুড ফ্রাইডে, বুদ্ধপূর্ণিমা, মহরম, ইদুলফিতর, মহাবীর জয়ন্তী ইত্যাদি।
(গ) লোক উৎসব: চড়ক বা গাজন, বনদুর্গা, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, পির ও গাজির উৎসব, লালনোৎসব, ইদ পরব, ইতু, টুসু, ভাদু পরব, অম্বুবাচি, বোলান, বিশ্বকর্মা, গন্ধেশ্বরী, গোরক্ষনাথ, পৌষপার্বণ (নবান্ন), ত্রিনাথ পূজা, আউনি-বাউনি ইত্যাদি।
(ঘ) সামাজিক উৎসব : ভাইফোঁটা, বিবাহ, জামাইষষ্ঠী, বিজয়া, সইপাতানো, নববর্ষ, হালখাতা ইত্যাদি।
(ঙ) জাতীয় উৎসব: স্বাধীনতা দিবস (১৫ আগস্ট), প্রজাতন্ত্র দিবস (২৬ জানুয়ারি), রবীন্দ্র জয়ন্তী, গান্ধি জয়ন্তী, রামকৃম্ন ও বিবেকানন্দ জয়ন্তী, নেতাজি জয়ন্তী ইত্যাদি।
এ ছাড়াও প্রাচীনকালে পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠা, ভূমিদান, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি উপলক্ষ্যেও উৎসব হত। এখন সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত, তাই অনেক প্রাচীন উৎসবও অবলুপ্ত। অবশ্য তার পরিবর্তে বাংলার সরস ভূমিতে নব নব উৎসবেরও জন্ম হয়েছে। যেমন লোক উৎসব, বনমহোৎসব, যাত্রা উৎসব, নাট্য উৎসব, শিল্প উৎসব ইত্যাদি।
দুর্গোৎসব
বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। শরতের শিউলি-ঝরা আঙিনায় দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে এক অভাবনীয় আনন্দময় মহোৎসবে মেতে ওঠে আপামর বাঙালি। দেবীর পূজা পাঁচদিনব্যাপী হলেও তাকে ঘিরে উৎসবের রেশ শুরু হয়ে যায় মাসখানেক আগে থেকেই এবং প্রতিবছরের পূজাবসানের পরের মুহূর্ত থেকেই বাঙালির মনে শুরু হয় পরের বছরের দুর্গোৎসবের জন্য অধীর অপেক্ষা।
বৈচিত্র্য
বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস বাংলাদেশে। বাঙালি ক্রিসমাসে যেমন মাতোয়ারা হয়, তেমনি ইদ, মহরম, বুদ্ধ পূর্ণিমাতেও বাংলার সমাজজীবনে উৎসবের রেশ সঞ্চারিত হয়। মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ প্রত্যেক সম্প্রদায়ের উৎসবই বাংলার উৎসবের উদার প্রাঙ্গণে শামিল হয়ে সার্বিকভাবে বাংলার উৎসবকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
উপসংহার
উৎসবের মূল চেতনা হল মানুষের কল্যাণসাধন। দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতা, গতানুগতিকতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষের মন সততই আকুল। উৎসব মানুষের জীবনের এই চাহিদাকে পূরণ করে। উৎসব মিলন, মৈত্রী ও শান্তির বাণী বহন করে। নিজস্বতা, বৈচিত্র্য ও আড়ম্বরে সমৃদ্ধ বাংলার উৎসব বাঙালির জীবনযাপনকে করেছে আনন্দময় ও পরিপূর্ণ।