প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেসব বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণগুলিকে আমরা দু-ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি-পরোক্ষ কারণ ও প্রত্যক্ষ কারণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণ

বলকান জাতীয়তাবাদ। বলকান অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল। সার্বিয়া ছিল বলকান অঞ্চলের ‘সর্ব শ্লাভ’ আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়। তাই সার্বিয়া চাইছিল তার নেতৃত্বে শ্লাভ রাষ্ট্রগুলি ঐক্যবদ্ধ হোক। কিন্তু অস্ট্রিয়া স্নাভ জাতি অধ্যুষিত বসনিয়া ও হারজেগোভিনা নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে রেখেছিল। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার অধিবাসীরাও অস্ট্রিয়ার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল।

ইউরোপের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ

ইউরোপের অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। জার্মানি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের কাছ থেকে আলসাস ও লোরেন দখল করেছিল। কিন্তু ফ্রান্স আলসাস ও লোরেন ফিরে পেতে উদ্‌স্ত্রীব ছিল। এ ছাড়া বুলগেরিয়া, রোমানিয়া এবং ম্যাসিডোনিয়া-ও বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ ছিল।

উগ্র জাতীয়তাবাদ

উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশ রচনা করেছিল। এই সময় ইউরোপের প্রায় সব জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত এবং একে অন্যের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইত। জার্মানরা ‘টিউটন’ (Teuton) জাতির, ইংরেজরা ‘অ্যাংলো-স্যাক্সন’ (Anglo-Saxon) জাতির সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল।

সাংবাদিক ও দার্শনিকদের ভূমিকা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্যে সাংবাদিক ও দার্শনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সময় সংবাদপত্রগুলিতে মিথ্যা, বিকৃত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ পরিবেশিত হত। ফলে জনগণের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। দার্শনিকরাও অনেক সময় তাদের মতবাদ দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত করতেন।

বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিযোগিতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বাণিজ্যিক ও ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ দেশে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির বাজারের চাহিদায় এবং শিল্পের উপযোগী কাঁচামাল। সংগ্রহের জন্য এইসময় উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল।

ফ্রান্স-জার্মান প্রতিদ্বন্দ্বিতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ফ্রান্স-জার্মান প্রতিদ্বন্দিতা। সেডানের যুদ্ধে (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে) বিসমার্ক ফ্রান্সের কাছ থেকে আলসাস ও লোরেন ছিনিয়ে নিয়ে জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু ফ্রান্স আলসাস ও লোরেন ফিরে পাওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিল বলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

সামরিক প্রস্তুতি

ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা ও সামরিক প্রস্তুতির পরিণতি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ম জার্মানিকে শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করার জন্য সামরিক প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। অন্যদিকে জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে বিচলিত ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড নিজ নিজ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।

আন্তর্জাতিক সংকট

সর্বোপরি কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংকট প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিল। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল– মরক্কো সংকট, আগাদি সংকট, বলকান সংকট প্রভৃতি।

পরস্পরবিরোধী শক্তিজোট গঠন

সাম্রাজ্যবিস্তার, পারস্পরিক সন্দেহ, জাতিবিদ্বেষ প্রভৃতি কারণে রুমে ইউরোপে দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তিশিবির গড়ে ওঠে। এর একদিকে ছিল- ট্রিপল অ্যালায়েন্স (Triple Alliance) বা ত্রিশক্তি চুক্তি-যা জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালিকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল এবং অন্যদিকে ছিল- ট্রিপল আঁতাত (Triple Entente) বা ত্রিশক্তি মৈত্রী-যা ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এমতাবস্থায় সেরাজেভো হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ

সেরাজেভো হত্যাকান্ড (Assassination at Sarajevo)

সেরাজেভো ছিল বসনিয়ার রাজধানী। অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ (Archduke Francis Ferdinand) ও তাঁর পত্নী সোফিয়া (Sophie) সেরাজেভো শহরে পরিভ্রমণে এসেছিলেন। এখানে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুন শ্লাভ বিপ্লবী সংগঠন ‘ব্ল্যাক হ্যান্ড’ (Black Hand) বা ‘ইউনিয়ন অফ ডেথ’ (Union of Death)-এর সদস্য গাব্রিলো প্রিন্সেপ (Gavrilo Princip) যুবরাজ ও রানিকে হত্যা করে। এই ঘটনা ‘সেরাজেভো হত্যাকাণ্ড’ (Assassination at Sarajevo) নামে পরিচিত।

এই ঘটনার জন্য অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং এক চরমপত্র দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার শর্তগুলি পূরণ করতে বলে। কিন্তু সার্বিয়ার পক্ষে সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এতে অস্ট্রিয়া ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরে সার্বিয়ার পক্ষে রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ার পক্ষে জার্মানি, তুরস্ক, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশ যোগদান করলে এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন – ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো

Leave a Comment