প্রকৃতির অভিশাপ দাবানল রচনা |
ভূমিকা
আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞানের জোরে আজ সমগ্র পৃথিবীটাই মানুষের করায়ত্ত। জল, স্থল, আকাশ, বাতাস সবকিছুকেই বিজ্ঞান মুষ্টিবদ্ধ করেছে। বিজ্ঞানের জোরে প্রকৃতির সৃষ্টিকে ক্রমাগত জয় করার উল্লাসে মানুষ প্রকৃতির পবিত্রতা ধ্বংস করেছে। কিন্তু বিজ্ঞানগর্বে গর্বিত মানুষ বোঝেনি প্রকৃতির গুরুত্ব। তাইতো প্রকৃতিও আজ ফিরিয়ে দিয়েছে প্রত্যাঘাত। ক্রমাগত বেড়েই চলেছে দাবানল, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ। তাই বিজ্ঞান অসহায় হয়ে পড়েছে প্রকৃতির কাছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী দাবানলের কাছে মানুষের অসহায়তা এই ঘটনারই সাক্ষ্য দেয়।
দাবানল কী?
বিস্তীর্ণ বনভূমি অঞ্চলে শুষ্ক ঋতুতে যদি কোনো কারণে আগুন লেগে যায় তাহলে সেই আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে গাছের পর গাছে। শুকনো ডালপালায় আগুন ধরে যায়। দূর থেকে দেখা যায় আগুনের লেলিহান শিখা। বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যায় একরের পর একর জমি। বন্যপ্রাণীদের প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। বহু লুপ্তপ্রায় প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
দাবানল সৃষ্টির কারণ
শুষ্ক মরশুমে বনভূমিতে বজ্রপাত হলে অনেকসময় বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টি হতে পারে। আবার অগ্ন্যুৎপাতের সময় জ্বলন্ত পাথরের টুকরো অরণ্যের শুষ্ক ডালপালায় ছিটকে পড়েও দাবানলের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। তবে দাবানল সৃষ্টির পিছনে মূলত দায়ী আধুনিক মানুষ ও সভ্যতা। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাসস্থানের প্রয়োজনে, ঝুম চাষ পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করার ফলে অথবা পশুপালনের প্রয়োজনে বিপুল পরিমাণে বনাঞ্চল কেটে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ সময়েই এই আগুন থেকে সৃষ্টি হয় ভয়ংকর দাবানল।
সাম্প্রতিক কালের দাবানল
সমগ্র বিশ্বে প্রতিবছর দাবানলের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল, বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে বা পেরুর মতো দেশগুলির অরণ্য প্রতিবছরই দাবানলের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুষ্ক ঋতুতে আমাজনে দাবানল এক অতি সাধারণ ঘটনা। তবে ২০১৯ সালে এই দাবানল ভয়াবহ আকার নেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় এবছর এই সংখ্যা ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। দাবানল থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ায় সমগ্র অঞ্চলের বাতাস দূষিত হয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবীর কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণকারী ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত এই আমাজনের অরণ্য ক্রমশ তার বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্যও হারিয়ে ফেলছে। লক্ষ লক্ষ বিরল প্রজাতির প্রাণীর প্রাণহানি ঘটছে। পাশাপাশি গ্লোবাল ওয়ার্মিং বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি একই চিত্র দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়াতেও। এদেশে দাবানলের প্রকোপে ১২০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে এবং নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত সতেরো জন। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদদের দেওয়া তথ্যানুসারে সমগ্র বছর জুড়ে আগুনের প্রভাবে প্রায় ৫০ কোটি স্তন্যপায়ী, পাখি ও সরীসৃপের মৃত্যু হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জীববৈচিত্র্যের প্রধান ইউক্যালিপটাস গাছ ও কোয়ালা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধুমাত্র বিদেশেই নয় দাবানলের রোষ থেকে মুক্তি পায়নি আমাদের দেশও। উত্তরাখণ্ডে প্রায় তিন মাস ধরে চলা দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এক হাজার নয়শো হেক্টর বনাঞ্চল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সাড়ে ছয় হাজার বনকর্মীকে কাজে লাগানো হয়েছে। তবে যথাযথ বৃষ্টিপাতই এই আগুন আয়ত্তে আনার একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উপসংহার
আধুনিক বিশ্বে মানুষের আগ্রাসী লোভই প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। বাড়িয়ে তুলেছে দাবানলের ঘটনা। মানুষের সতর্কতাই একমাত্র পারে এর ভয়াবহতা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। তাই সুস্থ পৃথিবীর কামনায় সমগ্র মানবসমাজকে এগিয়ে এসে প্রকৃতি ধ্বংস না করার, যথেচ্ছভাবে গাছ না কাটার শপথ নিতে হবে। কারণ প্রকৃতির জল-মাটি-বাতাসে বেড়ে ওঠা মানবসমাজ প্রকৃতিকে সুস্থ রাখতে, তার শ্যামলিমা বজায় রাখতে দায়বদ্ধ।