পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজন ও সংরক্ষণ রচনা

পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজন ও সংরক্ষণ রচনা
পরিবেশ রক্ষায় বনসৃজন ও সংরক্ষণ রচনা
“দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা

সৃষ্টির আদিতে প্রকৃতি ছিল বিশুদ্ধ। তার পরিবেশের সমস্ত তন্ত্রীতে ছিল শুদ্ধতার আবেশ। প্রকৃতির লালনেই পৃথিবী ক্রমশ বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। মানুষকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন সজীব ও জড় উপাদানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা পরিবেশে তাদের পারস্পরিক অন্তঃক্রিয়ায় ভারসাম্য তৈরি হয়। সেই ভারসাম্য পরিবেশের সুস্থিতির জন্য একান্ত কাম্য। এই পরিবেশ মানবজীবনকে যেন অমৃতসুধা দান করে তাকে গভীর অন্তরঙ্গতায় আবদ্ধ করেছে।

পরিবেশের অন্যতম উপাদান বন

জন্মলগ্নে পৃথিবী ছিল অরণ্যবেষ্টিত ভূভাগ। মানুষের আবির্ভাব-মুহূর্ত থেকে গাছপালা মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। সভ্যতার সূচনালগ্নে মানুষ ছিল অরণ্যবাসী। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠে অরণ্যকে কেন্দ্র করে। সবুজ প্রকৃতি জীবনদায়ী অক্সিজেন দান করে মানুষের বাঁচা সম্ভব করেছে। গাছের ফল ও কন্দ খেয়ে মানুষ জীবনধারণ করেছে। বৈদিক সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার ছিল তপোবনে। শুধু মানুষ নয়, বিভিন্ন পশুপাখি গাছ তথা বনকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। এ ছাড়াও আসবাবপত্র, ওষুধ, প্রসাধনী, খাদ্য ও জ্বালানি ইত্যাদির জোগান দেয় এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে। সকল শক্তির উৎস সূর্য, আর সেই সৌরশক্তিকে সরাসরি আবদ্ধ করতে পারে একমাত্র গাছ। তাই পরিবেশের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান গাছ তথা বন।

দূষণপ্রবণ আধুনিক সভ্যতা ও পরিবেশ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্তারে মানুষ ক্রমশ প্রকৃতির উপর তার আধিপত্য কায়েম করেছে। মানুষ তার নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধানে ক্রমশ প্রকৃতির স্বাভাবিকত্বের উপর হস্তক্ষেপ করেছে। ফলে অরণ্যনিধন বেড়েছে। প্রথমে চাষবাসের জন্য, পরবর্তীকালে নগরায়ণ ও শিল্পাঞ্চলের জন্য ব্যাপক বৃক্ষনিধন ঘটেছে। তাই মানুষের আবির্ভাবলগ্নে পৃথিবীর স্থলভাগের সবটুকু অরণ্য থাকলেও এখন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অরণ্যটুকুও নেই। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজন ৩৩-৩৫ শতাংশ বনভূমি। সেখানে পৃথিবীতে ও ভারতে বর্তমান বনভূমির হার যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ২৩.১ শতাংশ। প্রয়োজনীয় বনভূমি না থাকার ফলে কমছে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ, বাড়ছে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ। বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে তাপমাত্রা। অনাবৃষ্টির ফলে প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজে, কমছে ভূগর্ভস্থ জল। ভূমিক্ষয় রোধ না হওয়ার জন্য বাড়ছে বন্যা। অবলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার পশুপাখি।

বনসৃজন ও সংরক্ষণ

‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ’-রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তি আজ একান্তভাবে স্মরণযোগ্য। যে সর্বগ্রাসী পরিবেশদূষণ পৃথিবীর লালিত্য, মহিমা ধ্বংস করতে উদ্যত; তাকে রোধ করতে আজ বৃক্ষরোপণ প্রয়োজনীয়। সভ্য মানুষ নিজেদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে অনুভব করতে পেরেছে অরণ্যের গুরুত্ব। তাই সমগ্র বিশ্বব্যাপী বনসৃজন ও তা সংরক্ষণের সচেতনতা দেখা দিয়েছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে পৃথিবীর কোনো প্রাকৃতিক সম্পদই অফুরন্ত নয়। জল, বায়ু, মাটি, বন ও বন্য প্রাণী এসবই প্রাকৃতিক সম্পদ। জীবগোষ্ঠীর সার্বিক মঙ্গলের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধ, তার পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও সীমিত ব্যবহারকে সংরক্ষণ বলে। আর নতুন করে গাছ লাগানোকে বলা হয় বনসৃজন। দেরিতে হলেও ভারতে বনসৃজন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের উল্লেখযোগ্য সংরক্ষিত অভয়ারণ্য হল-ওড়িশার সিমলিপাল, বিহারের হাজারিবাগ ও পালামৌ, অসমের মানস ও কাজিরাঙা, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন, উত্তরপ্রদেশের করবেট ইত্যাদি।

উপসংহার

সভ্যতার এই দ্রুত অগ্রগতির লগ্নে যে পরিমাণে অরণ্যনিধন হচ্ছে, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। আধুনিক সভ্যতাকে অস্বীকার করার অবকাশ আমাদের নেই। তবে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সার্বিক উন্নতি ও বিকাশের প্রয়োজনে আমরাও বলতে পারি-

‘গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও

গাছের সবুজটুকু শরীরে দরকার 

আরোগ্যের জন্যে ঐ সবুজের ভীষণ দরকার।’

Leave a Comment