নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কীভাবে ফ্রান্সে ক্ষমতালাভ করেন
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (Napoleon Bonapart) কীভাবে ফ্রান্সে ক্ষমতালাভ করেন |
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কীভাবে ফ্রান্সে ক্ষমতালাভ করেন
ভূমিকা
ফরাসি বিপ্লব যখন শোচনীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল এবং ডিরেক্টরির শাসনের ব্যর্থতা ও ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমণ যখন ফ্রান্সের জনজীবনকে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, সেই জটিল মুহূর্তে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর অভাবনীয় সামরিক প্রতিভার দ্বারা ফ্রান্সকে রক্ষা করেন এবং ফরাসি জাতির ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
নেপোলিয়নের বাল্যজীবন
- জন্ম : নেপোলিয়ন ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ইটালির অন্তর্গত কর্সিকা দ্বীপের অ্যাজাকিও (Ajaccio) শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
- পিতা-মাতা: নেপোলিয়নের বাবার নাম কার্লো বোনাপার্ট ও মায়ের নাম লেটিজিয়া বোনাপার্ট।
- শিক্ষালাভ ও কর্মজীবন : ১৬ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান এবং তাঁরা কঠোর দারিদ্র্যের সম্মুখীন হন। তিনি প্যারিসের সামরিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করে ১৭ বছর বয়সে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর সাব-লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন (১৭৮৫ খ্রি.)।
নেপোলিয়নের উত্থানের সূচনা
নেপোলিয়নের উত্থানের কাহিনি ছিল রোমাঞ্চকর এবং এটি তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। যথা-
প্রথম পর্যায়
- ব্রিগেডিয়ার পদ লাভ : ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ফ্রান্সের তুঁলো (Touloun) বন্দর অবরোধ করে। নেপোলিয়ন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলো বন্দর পুনরুদ্ধার করেন। এই সাফল্যের পুরস্কার হিসেবে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন।
- মেজর জেনারেল পদ লাভ : ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর রাজতন্ত্রের সমর্থক ও প্রজাতন্ত্রের বিরোধী উচ্ছৃঙ্খল জনতা ন্যাশনাল কনভেনশন আক্রমণ করে। নেপোলিয়ন অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে এই বিশাল জনতার আক্রমণ থেকে ন্যাশনাল কনভেনশনের সদস্যদের রক্ষা করেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
- নেপোলিয়নের ইটালি অভিযান : ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর ন্যাশনাল কনভেনশনের শাসন শেষ হয় এবং ডিরেক্টরির শাসন শুরু হয়। এই সময় ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও সার্জিনিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। নেপোলিয়ন এই শত্তিজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সসৈন্যে ইটালি অভিযান করেন।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সাফল্য
- সার্ডিনিয়া জয় : প্রথমে তিনি সার্ডিনিয়াকে পরাজিত করে সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য করেন এবং স্যাভয় ও নিস দখল করেন।
- অস্ট্রিয়া আক্রমণ ও ক্যাম্পো ফর্মিও সন্ধি (Campo Formio Treaty): তিনি উত্তর ইটালিতে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করেন। অস্ট্রিয়ার সম্রাট তাঁর সঙ্গে ক্যাম্পো ফর্মিও-র সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন (১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর)।
- ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মিশর অভিযান : এরপর নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মিশর অভিযান করেন। তিনি (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই) পিরামিডের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও নীলনদের যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি নেলসনের হাতে পরাজিত হন। এরপর তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় পর্যায়
ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ও কনসুলেট শাসনের সূচনা : ফ্রান্সের জনগণ ডিরেক্টরি শাসনে (১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রি) অসন্তুষ্ট হয়েছিল। এই অবস্থার সুযোগে নেপোলিয়ন সসৈন্য কাউন্সিলে উপস্থিত হন। নেপোলিয়নের অনুগত ডিরেক্টর ও সদস্যগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ডিরেক্টরি শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। ফলে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্সে কনসুলেটের শাসনের সূচনা হয় (৯ নভেম্বর, ১৭৯৯ খ্রি)।
তিনজন কনসালের উপর শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়। এর মধ্যে নেপোলিয়ন হলেন সর্বশক্তিমান প্রথম কনসাল।
ফ্রান্সের প্রথম কনসাল হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করে নেপোলিয়ন ফ্রান্স-বিরোধী দ্বিতীয় রাষ্ট্রজোট-এর আক্রমণ প্রতিহত করেন। এরপর ইটালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশ দখল করেন। এইসব সাফল্যের ফলশ্রুতিরূপে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ‘কাউন্সিল অফ স্টেট’-এর প্রস্তাব অনুসারে চিরজীবনের জন্য প্রথম তথা প্রধান কনসাল পদে অধিষ্ঠিত হন।
তৃতীয় পর্যায়
অবশেষে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে সিনেটের প্রস্তাবমতো গণভোটের মাধ্যমে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট রাজবংশীয় না হয়েও ‘ফরাসি জাতির সম্রাট’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ফরাসি প্রজাতন্ত্র নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফরাসি সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হয়।
মূল্যায়ন
এইভাবে বোনাপার্ট তৎকালীন ফ্রান্স তথা ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণনিপুণ সেনাপতি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এক সাধারণ পরিবারের সন্তান হয়েও নিজ দক্ষতায় ফ্রান্সের শাসক হয়েছিলেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফ্রান্সের ভাগ্যনিয়ন্ত্রা। তাই ঐতিহাসিকগণ তাঁর শাসনকালকে (১৭৯৯-১৮১৪ খ্রি.) ইউরোপের ইতিহাসে ‘নেপোলিয়নের যুগ’ (Age of Napoleon) বলে অভিহিত করেছেন।
Read More – An Astrologer’s Day MCQ