নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো

নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া আলোচনা করো।

ভূমিকা

ফরাসি বিপ্লবের জাতীয়তাবাদী আদর্শ নেপোলিয়নের বিজিত দেশগুলিতে এক জাতীয়তাবাদী আবেগের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ক্রমে জার্মানি, ইটালি, স্পেন, পোর্তুগাল প্রভৃতি দেশের মানুষ জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পথে অগ্রসর হয়েছিল। স্থানীয় প্রতিষ্ঠান, দেশীয় রীতিনীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাষার উপর তীব্র আঘাত হেনে, এমনকি বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব মেনে না নেওয়া, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ প্রভৃতি স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক নীতি, আদর্শ ও কর্মপন্থা নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।

ফ্রান্স

ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য’ নীতির ফলে নেপোলিয়ন সিংহাসনে বসলেও-

  • বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, ফরাসি উপনিবেশে ক্রীতদাসপ্রথা পুনঃপ্রবর্তন এবং জোকোবিনদের গণভোট ও প্রজাতন্ত্রের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে তিনি ফরাসি জনগণের আস্থা হারিয়েছিলেন।
  • আবার তাঁর শিক্ষানীতি ও পোপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি ছিল বিপ্লবী ভাবধারার বিরোধী।
  • তিনি সার্বিক ভোটাধিকার ও গরিবদের জন্য ‘ল অফ মিনিমাম’ ও ‘ল অফ ম্যাক্সিমাম’ পুনঃপ্রবর্তন না করায় সমালোচিত হয়েছিলেন।
  • সর্বোপরি তাঁর বিদেশনীতি, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা, নতুন নতুন সামরিক অভিযানগুলির ব্যয়নির্বাহের জন্য করভার বৃদ্ধি এবং বহু মানুষের মৃত্যুতে ফরাসি বুর্জোয়া ও শিল্পপতিদের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ মানুষও নেপোলিয়ন বিরোধী মনোভাব পোষণ করেন তথা ‘মুক্তিদাতার’ বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের’ জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।

জার্মানি

প্রাথমিক পর্বে নেপোলিয়নের শাসনকে জার্মান জাতি তথা কিছু দার্শনিক ও সাহিত্যিকগণ ভূয়সী প্রশংসা করলেও তাঁর স্বৈরাচারী শাসনপ্রণালীতে অত্যাচারিত প্রাশিয়ার দেশপ্রেমিক স্টাইন, হিন্ডেনবার্গ প্রমুখ শাসন ও শিক্ষাসংস্কারের মাধ্যমে জার্মান জাতির মনে নবপ্রেরণা সঞ্চার করেন। এমনকি কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্ররা জার্মানির মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত জার্মানবাসীরা প্রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নেপোলিয়ন বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

আইবেরীয় উপদ্বীপ

আইবেরীয় উপদ্বীপেও নেপোলিয়ন বিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ‘উপদ্বীপীয়’ বা ‘পেনিনসুলার যুদ্ধ’-এর মাধ্যমে। নেপোলিয়ন ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বার্লিন ডিক্রি’ জারি করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ‘মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা’ গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করলে পোর্তুগাল তা মানতে অস্বীকার করে। ফলে নেপোলিয়ন স্পেনের সঙ্গে ঐক্যবন্ধ হয়ে পোর্তুগাল দখল করে নেন (১৮০৭ খ্রি.)। পোর্তুগাল দখলের পর সামরিক কারণে তিনি স্পেনও দখল করেন (১৮০৮ খ্রি.) এবং নিজ ভ্রাতা জোসেফ বোনাপার্টকে সিংহাসনে বসান। ফলে স্পেনের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহর নেপোলিয়নবিরোধী গণ অভ্যুত্থানে উত্তাল হয়ে ওঠে। ক্রমে এই বিদ্রোহ সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনবাসী ‘জুন্টা’ ও গেরিলাবাহিনী গঠন করে ফ্রান্সের সৈন্যের মোকাবিলা করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই বিদ্রোহ ছিল স্পেনীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া।

উপসংহার

স্পেনের বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে পোর্তুগালেও নেপোলিয়নবিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ইংল্যান্ডের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত স্পেন জয়লাভ করে। ফলত নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তি এই যুদ্ধের ফলে বিনষ্ট হয়। স্পেনের বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত হয়ে অস্ট্রিয়া, প্রাশিয়া, রাশিয়া, সর্বত্রই জনজাগরণ শুরু হয় এবং নেপোলিয়নের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

Leave a Comment