নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন – রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করলে জারকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন।
 
তো চলুন আজকের মূল বিষয় নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন পড়ে নেওয়া যাক।

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন
নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন?

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ

রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার নেপোলিয়নের মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করলে জারকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন।

সেনাবাহিনী গঠন : ফ্রান্স ছাড়াও ইউরোপের প্রায় ২০টি দেশ থেকে সংগৃহীত সৈন্য নিয়ে মোট ৬ লক্ষ ৮০ হাজার সেনাদল গঠন করেন-যা মহতী সেনা বা গ্র্যান্ড আর্মি (Grand Army) নামে খ্যাত। নেপোলিয়ন মনে করেছিলেন সংখ্যাধিক্যের জোরে ও আক্রমণাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে অতি দ্রুত রুশ অভিযান সম্পন্ন করবেন।

রাজনৈতিক মত-পার্থক্য

নেপোলিয়ন রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে সচেষ্ট হন এবং ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে টিলসিট-এর সন্ধি ও পরের বছরে এরফুটের সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স ও রাশিয়ার সমঝোতা স্থাপিত হয়। কিন্তু এই মিত্রতায় অচিরেই ফাটল ধরে। টিলসিটের সন্ধির কিছু দিনের মধ্যেই নেপোলিয়ন সম্পর্কে রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার-এর মোহভঙ্গ হয়। জার চেয়েছিলেন যে নেপোলিয়নের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তুরস্ক সাম্রাজ্য ভাগ করা যাবে এবং কনস্ট্যান্টিনোপলের উপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। কিন্তু নেপোলিয়ন তুরস্ক সাম্রাজ্য ভাগ করতে রাজি হলেন না। এরপর বাধল পোল্যান্ড নিয়ে মতবিরোধ। নেপোলিয়ন গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়ারশ গঠন করার পর রাশিয়ার ভয় হল যে এবার বুঝি নেপোলিয়ন রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডের এলাকা গ্রাস করে নেবেন। জার নেপোলিয়নের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চাইলেন যে পোল্যান্ডকে কখনোই একটি পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে না। কিন্তু নেপোলিয়ন কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে চাইলেন না। ফলত ফরাসি-রুশ সম্পর্কে ফাটল বৃদ্ধি পেল।

অর্থনৈতিক সংঘাত

রাজনৈতিক মন কষাকষির পর শুরু হল অর্থনৈতিক সংঘাত। নেপোলিয়ন কর্তৃক আরোপিত মহাদেশীয় ব্যবস্থা পালন করতে রাশিয়া প্রথমে সম্মত হয়। কিন্তু ক্রমশ রাশিয়া প্রচণ্ড আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাশিয়ায় পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় রাশিয়া ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে মহাদেশীয় অবরোধ মানতে অস্বীকার করে। এরফলে নেপোলিয়ন রাশিয়ার উপর ক্ষুব্ধ হন।

এই সব কারণে নেপোলিয়ন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে, ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত গ্র্যান্ড আর্মি নিয়ে সদর্পে রাশিয়া অভিযান শুরু করেন।

রাশিয়া অভিযানে নেপোলিয়নের ব্যর্থতা

বিভিন্ন কারণে নেপেলিয়নের রাশিয়া অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, যেমন :

রাশিয়ার পোড়ামাটি নীতি

রুশ সেনাপতি কুটুজফের নেতৃত্বে রুশবাহিনী ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে পিছু হঠতে থাকে। উদ্দেশ্য ফরাসি বাহিনীকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে নেওয়া। পিছু হঠার সময় রুশ বাহিনী ‘পোড়ামাটির নীতি’ নেয়। অর্থাৎ তাদের পিছু হঠার পথে শস্যখেত, খাদ্যভাণ্ডার, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, সেতু সব পুড়িয়ে দেয় এবং খাদ্য ও পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেয়। যাতে ফরাসিবাহিনীর খাদ্য, লোক, ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নেপোলিয়নের অনভিজ্ঞ মহতী সেনা এর ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

বোরোডিনের যুদ্ধ

১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ৭ সেপ্টেম্বর মস্কো থেকে ৭৫ মাইল দূরে বোরোডিনো গ্রামে রুশবাহিনী ফরাসিবাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। বোরোডিনের যুদ্ধে নেপোলিয়ন জয়যুক্ত হলেও রুশবাহিনী আত্মসমর্পণ না করে আরো পিছিয়ে যেতে থাকে।

মস্কো দখল

বোরোডিনো থেকে ৭৫ মাইল দূরে মস্কো পৌঁছাতে ফরাসি সেনার সময় লেগেছিল সাত দিন। এই দীর্ঘ পথ অতিক্রমকালে রোগ, মহামারি ও শীতের প্রকোপে তার সেনাদলের এক বিরাট অংশ প্রাণ হারায়। নেপোলিয়নের সেনাসংখ্যা তখন ১ লক্ষ। এই ১ লক্ষ সেনা নিয়ে বিনা বাধায় মস্কো শহরের দখল নেন। রুশরা মস্কোর লোকজন সরিয়ে শহরটি ভস্মীভূত করে দেন। প্রবল শীত, খাদ্যাভাব, বাসস্থানের অভাব নেপোলিয়নকে দিশেহারা করে দেয়। তিনি ৫ সপ্তাহ মস্কো শহরে অপেক্ষা করেন। তাঁর ধারণা ছিল রুশজার তাঁকে সন্ধির প্রস্তাব দেবে। কিন্তু জারের কাছ থেকে এই রকম কোনো প্রস্তাব না আসায় অগত্যা নেপোলিয়ন মস্কো ত্যাগ করে ফেরার পথ ধরলেন।

দেশে প্রত্যাবর্তন

নেপোলিয়ন যখন দেশে প্রত্যাবর্তনের পথ ধরলেন তখন হঠাৎ প্রচণ্ড শীত পড়ে গেল। শীতের সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হল বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত। টাইফাস জ্বরের প্রকোপ, কসাক গেরিলা বাহিনী, রুশ গোলন্দাজ বাহিনী ও বন্যজন্তুর আক্রমণে অগণিত ফরাসি সেনা মারা যায়।

এভাবে নেপোলিয়ন ৩০ থেকে ৫০ হাজার সেনা, একরাশ অপমান ও ব্যর্থতার গ্লানি দিয়ে দেশে ফেরেন। রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা সামরিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি তাঁর পতনকেও সুনিশ্চিত করে।

নেপোলিয়ন ২৪ জুন ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে রাশিয়া অভিযান করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ৩০ থেকে ৫০ হাজার সৈন্য বিরাট অপমানের বোঝা ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়। 

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান ব্যর্থতার কারণ

নেপোলিয়নের দম্ভ

নেপোলিয়ন ক্ষমতার দম্ভে বাস্তববোধ ও সম্ভব অসম্ভবের সীমারেখা সম্পর্কে ধারণা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি রুশ দুর্গকে বালির তৈরি দুর্গ ও রুশ জারকে অযোগ্য ও অপদার্থ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এটা ছিল একটি মারাত্মক ভুল।

পোড়ামাটি নীতি

ফরাসি সেনারা রাশিয়ার ভেতর প্রবেশ করলে রুশ সেনারা পিছিয়ে যেতে থাকে। পিছিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তাঘাট, সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়। শস্যক্ষেত্রগুলিতে আগুন লাগিয়ে, খাদ্য ও পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেয়। যাতে নেপোলিয়নের সেনারা খাদ্য ও পানীয় জল থেকে বঞ্চিত হয়। এই নীতি ছিল ফরাসি বাহিনীর মরণ ফাঁদ।

রাশিয়ার বিশাল আয়তন

দু’একটি ঝটিকা আক্রমণ বা সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে রাশিয়া জয় করা সম্ভব ছিল না। কারণ রাশিয়া ছিল বিরাট দেশ। অজগর সাপ যেমন তার শিকারকে মুখে ধরে তার বিরাট উদরে চালান করে হজম করে নেয়, রুশ সেনাপতি কুটুজফ তেমনি যুদ্ধ করার ভান করে যুদ্ধে না গিয়ে পিছু হঠতে থাকেন। নেপোলিয়ন তাঁর পিছু নিয়ে রাশিয়ার উদরে ঢুকে পড়েন। ফলে খাদ্য, অস্ত্র বা লোক সরবরাহ অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারি

রাশিয়ায় প্রচণ্ড শীত-বৃষ্টি ও তুষারপাত শুরু হলে রুশ কসাক বাহিনী গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণ ও শীতে হাজার হাজার সেনা মারা যায়। খাদ্যাভাব, শীতবস্ত্রের অভাব ও টাইপাস জ্বরের মহামারিতে।

রুশবাসীর সক্রিয় প্রতিরোেধ

রুশবাসীর আত্মত্যাগ, সংগ্রামী মনোভাব ও সক্রিয় প্রতিরোেধ নেপোলিয়নের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

জারের অনমনীয় মনোভাব

নেপোলিয়ন বোরোডিনের যুদ্ধে কুটুজকে পরাস্ত করে মস্কো নগরী প্রবেশ করে। তাঁর ধারণা ছিল জারের তরফ থেকে সন্ধির প্রস্তাব আসবে। কিন্তু জারের কাছ থেকে কোন প্রস্তাব না আসায় নেপোলিয়ন বুঝতে পারেন মহাভুল হয়ে গেছে। তারপর সেনাবাহিনীকে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন।

রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা শুধুমাত্র নেপোলিয়নের সামরিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল তা নয়, এর ফলে তাঁর পতনের পথ সুনিশ্চিত হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানকে সবচেয়ে চমকপ্রদ ও চূড়ান্ত ক্ষতিকারক পরাজয় বলেছেন (It was his most dramatic and costly defeat)।

আপনি আমাদের একজন মূল্যবান পাঠক। নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের কারণ কী? নেপোলিয়ন এই অভিযানে কেন ব্যর্থ হলেন -এই বিষয়ে আমাদের লেখনী সম্পূর্ণ পড়ার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না।

Leave a Comment