নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলি আলোচনা করো। |
অসামান্য সামরিক প্রতিভা বলে নেপোলিয়ন যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তা সর্বকালের জন্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। কালের অমোঘ নিয়মেই আজ যার অবস্থান তুঙ্গে একদিন তার পতন হবেই। নেপোলিয়নের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল না। নানা কারণের সমষ্টিগত ফলেই তাঁর পতন ঘটেছে।
সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা
নিজের শক্তি ও প্রতিভা সম্পর্কে নেপোলিয়নের আত্মপ্রত্যয় ছিল সীমাহীন। জেদের বশে তিনি এমন কিছু পরিকল্পনা দেন যা অসম্ভব ও অবাস্তব। এই সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর ব্যর্থতা ডেকে আনে।
স্ববিরোধী নীতি
নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ছিল স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। তিনি বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে ইউরোপের নানাদেশে সমাদৃত হয়েছিলেন। জনগণ তাঁকে মুক্তিদাতার আসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ইতালি, জার্মানি, স্পেন প্রভৃতি দেশে নিজের স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি বিপ্লবের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন। বিপ্লবের আশাবাদ ও তাঁর স্বৈরাচারী মনোভাবের সংঘাত অচিরেই তাঁর জনপ্রিয়তা নষ্ট করে এবং পতন ডেকে আনে।
ফরাসি জাতির আনুগত্য থেকে বিচ্ছিন্নতা
ফ্রান্সের সাধারণ শরিকদের কাছ থেকে ১৮১৪ খ্রি. নেপোলিয়ন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে লাইপজিগে তাঁর পরাজয়ের পর শত্রু সেনা ফ্রান্সে ঢুকে পড়লেও ফরাসি জাতি ছিল উদাসীন এবং অবিচল কারণ ফরাসি জাতি আর যুদ্ধ চাইছিল না, তারা শান্তির দাবি তোলে কিন্তু নেপোলিয়ন সেদিকে কর্ণপাত করেননি। তাছাড়াও বর্বর যুদ্ধ, অতিরিক্ত করভার, বিরক্তিকর শাসনব্যবস্থা, নিষ্ঠুরভাবে সৈন্যসংগ্রহ প্রভৃতি কারণে নেপোলিয়ন সাধারণ জনগণের থেকে বিছিন্ন হয়ে যান। তিনি গোটা জাতির সমর্থন হারান, যা তার পতনকে তরান্বিত করে।
নেপোলিয়নের সেনাদলের ক্রমিক দুর্বলতা
নিরন্তর যুদ্ধ বিগ্রহের ফলে নেপোলিয়নের অভিজ্ঞ ও যুদ্ধপটু সেনানী নিহত হয়। তিনি পদানত ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশ থেকে সৈন্যসংগ্রহ করে এই অভাব পূরণ করেন। ফলে সেনাদলের জাতীয় ঐক্য নষ্ট হয়, বিদেশি সেনার মধ্যে নেপোলিয়নের প্রতি কোনো ব্যক্তিগত আনুগত্য ছিল না। রাশিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে এই সেনাবাহিনীর ঐক্য ও মনোবল ভেঙে যায়। এই ভাড়াটে সৈনিকরা নেপোলিয়নের রণকৌশল আয়ত্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। ফলে গোড়ার দিকে নেপোলিয়ন যে সুবিধা ভোগ করতেন তা আর বিদ্যমান ছিল না।
ইংল্যান্ডের ভূমিকা
নেপোলিয়নের চিরশত্রু দেশ ছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নৌশক্তির ও আর্থিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছল ইংল্যান্ডের নিরন্তর বিরোধিতা মোকাবিলা করার ক্ষমতা বা ধৈর্য্য নেপোলিয়নের ছিল না। ইংল্যান্ডের এই বিরোধিতা তাঁর পতনের জন্য দায়ী।
মহাদেশীয় অবরোধের ব্যর্থতা
মহাদেশীয় অস্ত্র ইংল্যান্ডকে যতটা আঘাত করেছিল তার চেয়ে বেশি আহত করেছিল ফ্রান্সকে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে গোটা ইউরোপ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। তাই ফরাসিবাসীও তাঁর প্রতি আস্থা হারায়। এমনকি ইউরোপে মিত্রদেশগুলিও নেপোলিয়নের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়। ফলে মহাদেশীয় ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে যায়। এই মহাদেশীয় ব্যবস্থার ছিদ্রপথেই নেপোলিয়নের পতন শুরু হয়।
স্পেনীয় ক্ষত
নেপোলিয়ন অন্যায়ভাবে স্পেন অধিকার করে নিয়ে নিজের ভাই জোসেফকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ স্পেনবাসী নেপোলিয়নের এই অনৈতিক ও অন্যায় কাজ মেনে নিতে পারেনি। তারা পোর্তুগাল ও ইংল্যান্ডের সঙ্গে মিলিত হয়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যা উপদ্বীপের যুদ্ধ নামে খ্যাত। ৬ বছর ধরে এই যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের বিপুল অর্থ খরচ হয় ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। শত চেষ্টা করেও তিনি স্পেনকে পরাস্ত করতে পারেননি। তাই তিনি বলেছেন, স্পেনীয় ক্ষতই আমার পতন করেছে।
ধর্মীয় বিবাদ
নেপোলিয়নের সঙ্গে পোপ সপ্তম পায়াসের (Payas) এক ধর্ম মীমাংসা চুক্তিবলে ফ্রান্সে ক্যাথলিক ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে প্রোটেস্টান্টরা বিক্ষুব্ধ হয়। আবার পোপ মহাদেশীয় ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করেন। এর ফলে সমগ্র ক্যাথলিক জগৎ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।
রাশিয়া অভিযান
রাশিয়ার জার ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক সংকটের চাপেই মহাদেশীয় ব্যবস্থা তুলে দেন। এতে নেপোলিয়ন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং জার আলেকজান্ডারকে জব্দ করার জন্য মস্কো অভিযান করেন। নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড আর্মি প্রবল প্রত্যাশা জাগিয়ে শেষ পর্যন্ত রুশ গেরিলা বাহিনীর আক্রমণে পরাজিত ও ধ্বংস হয়ে যায়। এই ব্যর্থতা নেপোলিয়নের অপরাজেয় ভাবমূর্তি চুরমার করে দেয়।
জাতিসমূহের যুদ্ধ
নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা ইউরোপের দেশগুলিকে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়াইয়ে নামার প্রেরণা দেয়। ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে গঠিত চতুর্থ শক্তিজোট (ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়া) লিপজিগের যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করে। তাঁকে এলবা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। এলবা দ্বীপ থেকে তিনি শীঘ্রই ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং একশত দিন রাজত্ব করেন। অতঃপর ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুন মিত্রশক্তি নেপোলিয়নকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে দুর্গম সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করে। সেখানেই ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ৫মে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়।