নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা করো
নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বর্ণনা করো। |
নিম্নগতিতে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ
প্লাবনভূমি (Flood Plain)
সৃষ্টি: নিম্নগতিতে নদীর বোঝা নদীবক্ষকে ক্রমশ ভরাট করে নদীখাতের গভীরতাকে দ্রুত কমিয়ে দেয়। এই অবস্থায় বর্ষার অতিরিক্ত জল নদীতে এসে পড়লে নদীতে প্লাবন সৃষ্টি হয়। প্লাবনের পর নদীর পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি নদী উপত্যকার দু-পাশে সঞ্চিত হয়ে প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি করে।
বৈশিষ্ট্য: (i) প্লাবনভূমি প্রায় সমতল প্রকৃতির হয়। (ii) এটির দৈর্ঘ্য মোটামুটি 50-60 কিমি এবং প্রস্থে কয়েকশো মিটার থেকে কয়েক কিমি হয়। (iii) প্লাবনভূমি যথেষ্ট উর্বর প্রকৃতির হয়।
উদাহরণ: বিহারের রাজমহল অঞ্চলে গঙ্গার গতিপথের দুপাশে প্লাবনভূমি দেখা যায়। এ ছাড়া আমাজন, ইয়াংসি কিয়াং প্রভৃতি নদীর তীরেও এই প্লাবনভূমি গড়ে উঠেছে।
স্বাভাবিক বাঁধ বা লেভি (Natural Levee)
উৎপত্তি: বর্ষার সময় অতিরিক্ত জল অগভীর নদী উপত্যকা বহন করতে পারে না, নদীতে বন্যা দেখা দেয়, বন্যার জল দুকুল প্লাবিত করে প্লাবন সমভূমির সৃষ্টি করে। নদীর দুই তীরে মোটা দানার মতো নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি পদার্থ ক্রমে ক্রমে জমা হয়ে নদী তীর বাঁধের মতো উঁচু হয়ে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বাঁধ সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে আরো নিম্নপ্রবাহে নদী গতিপথ পরিবর্তন করলে স্বাভাবিক বাঁধগুলি দেখে পূর্ববর্তী নদীখাত সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
বৈশিষ্ট্য: (i) স্বাভাবিক বাঁধ কোনো নদীপথের সমান্তরালে গড়ে ওঠে। (ii) প্লাবনভূমির তল থেকে স্বাভাবিক বাঁধের উচ্চতা 3-4 মিটার হয়। (iii) স্বাভাবিক বাঁধ নিম্নগতিতে নদীর বন্যা প্রতিরোধ করে।
উদাহরণ: পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও মুরশিদাবাদে এরূপ অনেক স্বাভাবিক বাঁধ গড়ে উঠেছে।
বদ্বীপ (Delta)
নদীর মোহানা সংলগ্ন অংশে নদীবাহিত পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে মাত্রাহীন ‘ব’ কিংবা গ্রিক অক্ষর Δ (ডেল্টার) অবস্থান ন্যায় করলে তাকে বদ্বীপ বলে।
A N Strahler-এর মতে “যখন একটি নদী কোনো স্থির জলাশয়ে (Standing water) পতিত হয়ে সেখানে নুড়ি, পলি, বালি, কাদার সঞ্চয় করে, তাকে বদ্বীপ বলা হয়।”
সৃষ্টি: (i) নদীর মোহানায় সূক্ষ্ম পলির সঞ্চয় বৃদ্ধি। (ii) নদীগর্ভ অধিক পলি সঞ্চয় দ্বারা ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে ওঠে, ফলে, নদীর গভীরতা কমে যায়। (iii) ভূমি ঢালের অভাবে নদীতে স্রোত থাকে না বলে একটু বাধা পেলেই নদী শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়। (iv) নদীর দুই শাখার মধ্যবর্তী অংশে পলি সঞ্চয় ঘটে। (v) নদীর সঙ্গে সমুদ্রতরঙ্গ বাহিত পলিরও সঞ্চয় ঘটে, ফলে, নদী ও সমুদ্র দুইয়ের পলির সমন্বয় হয়। (vi) এরপর মাত্রাহীন ‘ব’-এর মতো বা গ্রিক অক্ষর ডেল্টার (△) মতো আকৃতির পরিণত বদ্বীপের উৎপত্তি ঘটে।
নামকরণ: নিলনদের মোহানায় ত্রিকোণাকার ভূমি দেখে ঐতিহাসিক হেরোডোটাস গ্রিক অক্ষর ডেল্টার (△) সঙ্গে তুলনা করে নাম দেন ‘ডেল্টা’।
শ্রেণিবিভাগ: বদ্বীপ বিভিন্ন প্রকারের হয়, যেমন ত্রিকোণাকার বদ্বীপ, ধনুকাকৃতি বদ্বীপ, পাখির পায়ের আকৃতিবিশিষ্ট বদ্বীপ, হ্রদ বদ্বীপ, সমুদ্র বদ্বীপ প্রভৃতি।
উদাহরণ: গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত বদ্বীপ পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম। এ ছাড়া হুগলি নদীর মোহানায় সাগরদ্বীপ, হাড়িয়াভাঙা নদীর মোহানার অনতিদূরে সৃষ্টি হয়েছে নতুন দ্বীপ পূর্বাশা।
খাঁড়ি (Estuary)
সৃষ্টি: নদীর মোহানা অঞ্চলে জলস্রোতের বেগ যদি বেশি থাকে অথবা, সমুদ্রের জোয়ার প্রবল হলে সেখানে পলি সঞ্চিত হতে পারে না। ফলে, নদীর মোহানাতে কোনো বদ্বীপ গঠিত হতে পারে না এবং জোয়ারের জল প্রবলবেগে নদীর মধ্যে প্রবেশ করে নদীখাতকে অধিক চওড়া ও বিস্তৃত করে খাঁড়ি সৃষ্টি করে।
উদাহরণ: টেমস নদীর মোহানা, ওব নদীর মোহানা (পৃথিবীর দীর্ঘতম খাঁড়ি) ইত্যাদি।