ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো
ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভূমিকা

বাংলাদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পর পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে একদল আদর্শবাদী তরুণ প্রচলিত হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনাচার, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-র প্রভাবে তরুণ ছাত্রদল উগ্র মানসিকতা নিয়ে ধর্ম ও সমাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ইতিহাসে তাঁরা নব্যবঙ্গ বা Young Bengal নামে পরিচিত।

পটভূমি

পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজজীবনে এক সাংস্কৃতিক আলোড়ন শুরু হয়। সচেতন মানুষেরা প্রচলিত ধর্ম, সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা অনুভব করে। এ ছাড়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডের চরমপন্থীদের চিন্তাধারা শিক্ষিত বাঙালিদের চেতনায় গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে উজ্জীবিত করেছিল। ফলে এক প্রগতিমূলক পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। এই পটভূমিতে ডিরোজিও আবির্ভূত হন।

ডিরোজিওর শিক্ষা ও আদর্শ

কলকাতার এক ইঙ্গ-পোর্তুগিজ পরিবারের সন্তান হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-৩১ খ্রি.) ভ্রমন্ডের ধর্মতলা আকাদেমি থেকে শিক্ষালাভ করেন। ডুমন্ডের মুক্ত চিন্তা ও আদর্শের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। ডিরোজিওর চারিত্রিক শুদ্ধতা, উচ্চ আদর্শ ও উদারতা হিন্দু কলেজের ছাত্রদের গভীরভাবে আকর্ষণ করে। ‘রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, “চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন।” তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। তাঁর চেষ্টায় ছাত্ররা লক, হিউম, বেকন, টম পেইন, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখ দার্শনিকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত হয়। তিনি ছাত্রদের স্বাধীন চিন্তা করতে এবং বিনা বিচারে কোনো কিছু গ্রহণ করতে নিষেধ করেন। সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলতেন, “সত্যের জন্য বাঁচো, অসত্য থেকে মুক্ত হও।”

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী

হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার সময় ডিরোজিওকে কেন্দ্র করে একটি ছাত্রগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা নব্যবঙ্গ বা Young Bengal নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- রামতনু লাহিড়ি, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ। ছাত্রদের যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে। এই সভায় ছাত্ররা ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, স্বদেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করত। বিতর্ক হত ভাগ্য, সত্য ও মূর্তিপূজা নিয়ে।

আন্দোলন

ডিরোজিও কেবল একজন অধ্যাপক ছিলেন না, তিনি ছিলেন উদীয়মান বাংলার এক প্রদীপ্ত প্রলয়শিখা। রামমোহন যে কাজ শুরু করেন, ডিরোজিও তাতে প্রচণ্ড গতি সঞ্চার করেন। তিনি ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ, সত্যবাদিতা ও যুক্তিবাদের আগুন প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন। তার ফলে হিন্দুধর্ম ও সমাজ এক গভীর সংকটে পড়ে। ডিরোজিও-র ছাত্র রসিককৃষ্ণ মল্লিক বলেন যে, “আমি গঙ্গানদীর পবিত্রতায় বিশ্বাস করি না”। তাঁরা নিষিদ্ধ গোমাংস খেতেন, উপবীত ধারণ করতেন না, মুসলমানের হাতে জল খেতেন, ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদের দেখে বলতেন, “আমরা গোরু খাই গো”। কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে বলতেন, ‘Good Morning, Madam’, মাধবচন্দ্র লেখেন, “আমরা হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে যেটা ঘৃণা করতাম, তা হল হিন্দুধর্ম।”

এই নেতিবাচক মনোভাব ও আচরণের পাশাপাশি তাঁরা প্রগতিমূলক সংস্কারের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা, সতীদাহপ্রথা ও প্রচলিত হিন্দুধর্ম বিষয়েও তাঁরা আলোচনা করতেন। পার্থেনন পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আলোচিত হত। ক্যালাইডোস্কোপ পত্রিকায় ইংরেজ শাসনের সমালোচনা করা হত।

সীমাবদ্ধতা

তবে নব্যবঙ্গ আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কারণ-

[1] তাঁদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা না নিয়ে তাঁরা হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করেন।

[2] এই আন্দোলন শহুরে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমিত ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের যোগ ছিল না। ড. অনিল শীল তাই বলেছেন, “They lived in Ivory tower”.

[3] কৃষক-শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তাঁরা ভাবতেন না।

[4] তাঁরা ছিলেন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গোষ্ঠী।

মূল্যায়ন

ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী বিশিষ্ট সম্মানের অধিকারী। শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, ডিরোজিও তিন বছরে তাঁর শিষ্যদলের মধ্যে এমন কিছু রোপণ করেছিলেন, যা তাদের অন্তরে আমরণ বিদ্যমান ছিল। তাঁরা বিভিন্ন পত্রিকার (এনকোয়ারার, বেঙ্গল স্পেকটেটর, হিন্দু পাইওনিয়ার) মাধ্যমে এবং জ্ঞানোপার্জিকা সভা ও বেঙ্গল-ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে খ্রিস্টান পাদরিদের গোঁড়ামি, স্ত্রী-পুরুষের অসম অধিকার, দাসপ্রথা, নারীনির্যাতন, সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণ, মরিশাসে ভারতীয় কুলি রফতানি, ভারতে পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা, বেগার শ্রম, একচেটিয়া বাণিজ্য, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। আধুনিকতার দিক থেকে তাঁদের চিন্তাধারা রামমোহনের চেয়েও প্রগতিশীল ছিল। অনেকে তাঁদের ‘নবজাগরণের ঊষালগ্ন’ বলেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁদের ‘A generation without father and children’ বলে নিন্দাও করেছেন।

Leave a Comment