জনজীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা
জনজীবনে সংবাদপত্রের ভূমিকা রচনা
|
ভূমিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামাজিক মানুষের অগ্রগতি সম্পর্কে একসময় লিখেছিলেন- ‘মনের চলাচল যতখানি, মানুষ ততখানি বড়ো। মানুষকে শক্তি দিতে হইলে মানুষকে বিস্তৃত করা চাই।’ মানুষের শক্তি বৃদ্ধি এবং তাদের বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো মাধ্যম অবশ্যই সংবাদপত্র।
সংবাদপত্র কী
‘সংবাদ’ শব্দের অর্থ খবর। সেদিক দিয়ে যেসব পত্রপত্রিকা মূলত খবর বা সংবাদ পরিবেশন করে, সেসব পত্রপত্রিকাকে বলা হয় সংবাদপত্র। শ্রেণিগত ক্ষেত্রে সংবাদপত্র হতে পারে দৈনিক, সাপ্তাহিক, সান্ধ্য, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ইত্যাদি ধরনের এবং বিভিন্ন সংবাদ, শিল্প-বাণিজ্য-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-খেলা-সিনেমা ইত্যাদি সংবাদপত্রের বিষয় হতে পারে।
কয়েকটি সংবাদপত্র
অনুমান করা হয় পৃথিবীর প্রথম সংবাদপত্র আবিষ্কৃত হয় চিন দেশে। আবার ইউরোপে প্রথম সংবাদপত্র দেখা যায় ইতালিতে। অন্যদিকে ভারতে প্রথম সংবাদপত্র জেমশ অগাস্টাস হিকি সাহেবের ‘বেঙ্গল গেজেট’ (১৭৮০) বাংলা ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। তার নাম ছিল ‘দিগদর্শন।’ বর্তমানে যেসব সংবাদপত্র খ্যাতনামা, সেগুলো হল-বাংলায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ইত্যাদি, হিন্দিতে ‘সন্মার্গ’ ইংরেজিতে ‘দি স্টেটসম্যান’, ‘নিউজ অব দি ওয়ার্লড’, ‘ডেইলি মিরর’, ‘সানডে এক্সপ্রেস’ ইত্যাদি।
সংবাদপত্রের ভূমিকাপালন
সংবাদপত্র মানবসভ্যতার ইতিহাসে এবং জনজীবনের পক্ষে এক অপরিহার্য গণমাধ্যম। কি প্রাচীনকাল কিংবা কি আধুনিককাল-সর্বকালেই এই গণমাধ্যম সমাজে তথা জনজীবনে নানান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। যেমন-
তথ্যপ্রদান : যে-কোনো সংবাদপত্রের প্রধান কাজ পাঠকের সামনে সমাজ, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, খেলা, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে নানান সংবাদ পরিবেশন, যা তথ্য হিসেবে পাঠকের কাছে গৃহীত হয়। সংবাদপত্রের এই ভূমিকা তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
জ্ঞানের প্রসার : পুথিগত জ্ঞানই মানুষের নুষের জীবনে একমাত্র জ্ঞান হতে পারে না। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নানান ঘটনা ঘটে চলেছে। পালটাচ্ছে নানান বিষয়ে মতামত, নতুন নতুন তথ্য ও সংযোজিত হচ্ছে। সংবাদপত্র সেসবের আধার। মানুষ তা পাঠ করে সেকারণে নিজেদের শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে পারে।
জাতীয়তাবোধের প্রসার : প্রাচীন ও আধুনিককালে জাতীয়তাবোধের প্রসারে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই উল্লেখ করা চলে। যেমন-ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনকালে বিপ্লবীদের এবং জনসাধারণকে স্বাধীনতার যজ্ঞে উদ্বুদ্ধ করতে কিছু সংবাদপত্র বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। আধুনিককালেও পৃথিবীর বহু সংবাদপত্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত আছে।
সচেতনতা বৃদ্ধি : জনগণ তাদের সমাজ-রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতে পারে না। সংবাদপত্র দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে যে পর্যালোচনা করে, তা পাঠ করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
সমস্যার সমাধান : আধুনিক পৃথিবীতে রয়েছে নানান সমস্যা ও জটিলতা। একটি দেশে যেমন থাকে ভাষা-জাতি-ধর্মগত সমস্যা, থাকে বিভেদের রাজনীতি: বিশ্ব-রাজনীতিতেও তেমনটা দেখা যায়। সংবাদপত্র সংবাদ পরিবেশনসহ বিদগ্ধজনের নানান আলোচনার ভিতর দিয়ে সেই সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকে।
জনমত গঠন : সুস্থ জনমত গঠন গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সুফল এনে দেয়। তাই এ সম্পর্কে বলা হয়- ‘This incessant activity of public opinion is the dynamic of democracy,’ আধুনিককালে সংবাদপত্র সরকারি নীতি, নানান পদক্ষেপের পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ, বিজ্ঞাপন ও চিঠিপত্র ছাপিয়ে, বিশেষজ্ঞের প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশ করে জনমত গড়ে তোলে।
উপসংহার
আধুনিক কবি, মননের কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বোধ’ কবিতায় একদা লিখেছিলেন এক অমোঘ বাণী-
সংবাদপত্র বর্তমানে যেন মানুষের সেই বোধের উন্মেষে কাজ করে। তবে জনজীবনে তথা মানবসমাজে উপকারী ভূমিকায়। সংবাদপত্রকে অবতীর্ণ হতে হলে সেসব সংবাদপত্রকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। তবেই তা থেকে পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত ফল।
আরও পড়ুন – 1943 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ গুলি কী ছিল