ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (Crimean War) ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (Crimean War) ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের (Crimean War) ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করো।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফল

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে ঐতিহাসিক মহল দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এই যুদ্ধকে অনাবশ্যক যুদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এই যুদ্ধের আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করেননি। ফরাসি ঐতিহাসিক ও মন্ত্রী থিয়ার্স (Thiers) ক্রিমিয়ার যুদ্ধকে অভিহিত করেছেন এইভাবে যে, গ্রোটো গির্জার চাবিকাঠি নিয়ে হীনমনোবৃত্তিসম্পন্ন যাজকদের মধ্যে দ্বন্দুপ্রসূত যুদ্ধ (A war to give a few wretched monks the key of Grotto)। অপরদিকে ঐতিহাসিক গ্রান্ট ও টেম্পারলি এই যুদ্ধকে “ইউরোপের ইতিহাসে এক বিশেষ যুদ্ধ” আখ্যা দিয়েছেন (The crimean war occupies a peculiar place in the history of Europe in the 19th century.)। অধ্যাপক এ জে পি টেলর (A JP Taylor) মনে করেন- “পারস্পরিক আগ্রাসন নয়, পারস্পরিক সন্দেহ থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত, যদিও এটি অনাবশ্যক যুদ্ধ নয়” (Mutual fear, not mutual aggression caused the Crimean War, nevertheless it was not a war, without a purpose.)

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলাফলকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।

প্রত্যক্ষ ফলাফল

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফলাফলগুলি হল-

  • এই যুদ্ধের দ্বারা বলকান অঞ্চল ও কৃল্পসাগরে বুশ অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। রাশিয়া তুরস্কের যেসব অঞ্চল দখল করেছিল, তুরস্ক সেগুলি ফেরত পায়।
  • তুরস্ক ইউরোপীয় শক্তি সমবায়ের সদস্যপদ লাভ করে। শক্তি সমবায় তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। শক্তি সমবায়ভুক্ত ইউরোপীয় আধুনিক রাষ্ট্রগুলির সংস্পর্শে এসে তুরস্ক আধুনিক সংস্কারের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবনের সুযোগ পায়।
  • ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন (Napoleon II) যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একই সঙ্গে তাঁর এবং ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন তিনি।

পরোক্ষ ফলাফল

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরোক্ষ ফলাফল ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। লর্ড ক্রোমার এই যুদ্ধকে “Watershed of European “History” অর্থাৎ “ইউরোপীয় ইতিহাসের জলবিভাজিকা” আখ্যা দিয়েছেন। জলবিভাজিকা বা ঝরনার জলধারার মতো ক্রিমিয়ার যুদ্ধও ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল।

  • ইউরোপে সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি প্রতিহত হওয়ায় রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় সেই নীতি অনুসরণ করে। এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
  • ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের ফলে জারতন্ত্রের দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধের পর থেকেই বুশ জনগণ জারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে। গণবিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য পরবর্তী জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (Alexander II) বেশ কিছু সংস্কার প্রবর্তন করেন। ও ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ইটালি ও জার্মানির ঐক্যের সহায়ক হয়। পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে যোগদান করে ইটালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করে। সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ক্যাজুর ইটালির ঐক্য প্রচেষ্টায় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সহানুভূতি আদায়ে সক্ষম হন।
  • ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়া রাশিয়াকে সমর্থন না করায় রাশিয়া জার্মানির ঐকা আন্দোলনে প্রাশিয়ার পক্ষ নেয়। প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক রাশিয়ার সাহায্যে জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য খর্ব করে জার্মানির ঐক্য প্রচেষ্টাকে সহজ করেন। ঐতিহাসিক কেটেলবি (Ketelbee) বলেছেন, ‘ক্রিমিয়ার যুদ্ধের ফলেই নব ইটালি এবং নব জার্মানি জন্মলাভ করে’ (It was out of the mud of Crimea that a new Italy was made and less obviously, a new Germany) |
  • ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর বলকান জাতিগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখা দেয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এই তৎপরতা বলকান অঞ্চলকে ইউরোপের অগ্নিকুন্ডে পরিণত করে।

গুরুত্ব

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। অনেকে এই যুদ্ধকে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ বলে মনে করেন। আবার অনেকে বলেন, এর ফলে-

  • বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার আগ্রাসন বাধাপ্রাপ্ত হয়।
  • তুরস্কের আধুনিকীকরণ সম্ভবপর হয় এবং
  • পরোক্ষভাবে ইটালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন সম্ভব হয়।

Leave a Comment