কোনো এক মহান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসার অভিজ্ঞতা রচনা |
ভূমিকা
জীবনের অপর নাম এগিয়ে চলা। চলার পথে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে থাকে। আর তারই স্পর্শে আমাদের জীবন আলোয় ভরে ওঠে, আমরা রসদ পাই বাঁচার। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল এমনই একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসার। তিনি প্রখ্যাত মার্গ সংগীতশিল্পী শ্রী রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর সান্নিধ্যেই কাটে আমার জীবনের এক মূল্যবান অধ্যায়। তাঁর সুরেই পাই জীবনে বাঁচার সঞ্জীবনী মন্ত্র।
প্রথম সাক্ষাৎ
ছেলেবেলা থেকেই আমি ছিলাম খেলাপাগল, ধ্যান জ্ঞান ছিল একমাত্র ফুটবল। নিছক কৌতূহল নিরসনেই একদা বাবার পুরোনো হারমোনিয়ামটা গোয়ালঘরের মাচা থেকে নামিয়ে সেটাকে সারিয়ে শুরু করেছিলাম সারেগামা। আমার মাসতুতো দাদা আমার কৌতূহল দেখে পরামর্শ দিল উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার। ক্লাসিক্যাল গান সম্পর্কে আমার ভয় ছিল প্রথম থেকেই। মাসতুতো দাদা আমায় অভয় দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সন্ধান দিল; সঙ্গে জানাল রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গান একবার শুনলে, আমি নাকি আর ভুলতে তো পারবই না, উপরন্তু সর্বদাই নাকি তাঁর গান বাজবে আমার কানে। সেই পরামর্শেই আমি পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়ি এবং তাঁর কাছেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ঘটল।
ব্যক্তিপরিচয়
হিন্দুস্থানি মার্গ সংগীতের একনিষ্ঠ সাধক, আমার গুরু, রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রেই তাঁর জীবনের নানা অলিগলির সন্ধান পেয়েছিলাম। তাঁর বাড়ি ছিল হাওড়া জেলার অন্তর্গত জেবিপুর থানার ইসলামপুর গ্রামে, যা ‘পানপুর’ নামেই খ্যাত। যদিও তাঁর আদি বাসস্থান ছিল আমতার তাজপুর গ্রামে। স্কুলে পড়ার সময় থেকে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যেই শুরু হয় তাঁর গানের তালিম। দারিদ্র্যের কারণে একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন পিডব্লিউডি-তে চাকরি করেন, পরবর্তীকালে চাকরি তিনি ছেড়ে দেন, ভালো না লাগার কারণে। এরপর থেকেই গানের সাধনায় মগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে তিনি হারমোনিয়াম উপহার পেয়েছিলেন মান্না দে-র কাছ থেকে।
তাঁর গুরু ছিলেন পণ্ডিত নারায়ণ রাও যোশীজি, যিনি কিংবদন্তি গায়ক আবদুল করিম খাঁ-র ছাত্র। গানকে এতটাই মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন তিনি যে, এই গানের টানেই তিনি ছেড়ে ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বপ্নের সরকারি চাকরি। সুদীর্ঘ ১৪-১৫ বছর জোশীজির কাছে তিনি তালিম নেন। গুরুজি হঠাৎ মারা যাওয়ার পর আইটিসি-তে পণ্ডিত কানন সাহেবের কাছে তালিম নেন তিনি। তারপর শিক্ষা নেন পণ্ডিত সৌমিত্র লাহিড়ির কাছে।
বর্তমানে তিনি একান্তে ক্লাসিক্যাল সংগীতসাধনার মধ্যেই ডুবে আছেন। কাজ করেন আকাশবাণী কলকাতায়। শুধু খেয়াল বা ঠুংরি নয়, যন্ত্রসংগীত হারমোনিয়ামও তাঁর প্রিয় বিষয়। তবলাতেও তিনি সমান পারদর্শী। আকাশবাণী সংগীতসম্মেলনে সহযোগী শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন বহু অনুষ্ঠানে। তিনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন মার্গ সংগীতে।
উপসংহার
খুব ছোটোবেলাতেই এইরকম অসাধারণ এক মানুষের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পাওয়াতে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। সুরের জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছেন তিনি আমার মজ্জাতে। তাঁর কল্যাণেই উপলব্ধি করতে পেরেছি সংগীতের প্রকৃত মর্যাদা। ক্লাসিক্যাল গানের মধ্যে যে এত জাদু আছে, এত ভালোলাগা আছে, তা তাঁর কণ্ঠে গান না শুনলে আমার অগোচরেই থেকে যেত। তাঁর গায়কিতে ‘ইমন’ শুনলে সত্যিই মন কেমন করে ওঠে। সুরের সাধনায় তিনি ত্যাগ করেছেন বহু কিছু। গানকে ভালোবেসে তিনি বিসর্জন দিয়েছেন নিজের স্বার্থ। আজকের দিনে এমন গুরু সত্যিই বিরল। সর্বশেষে তাঁকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও কৃতজ্ঞতা।