ঔপনিবেশিকতাবাদ’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কী? সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো

ঔপনিবেশিকতাবাদ' বা 'সাম্রাজ্যবাদ' কী? সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো
ঔপনিবেশিকতাবাদ’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কী? সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণগুলি আলোচনা করো।

ঔপনিবেশিকতাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ

শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে সাম্রাজ্যবাদ বলতে বিজিত দেশে স্থানিক অধিকার (Teritorial Domination) বলবৎ করাকেই বোঝাত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর সাম্রাজ্যবাদ বলতে বিজিত দেশের কেবল ভৌমিক অধিকারই নয়, তার জনশক্তি, সংস্কৃতিসহ সবকিছুকেই গ্রাস করে সাম্রাজ্যবাদী দেশের স্বার্থে ব্যবহার করাকে বোঝায়। এই ধরনের সাম্রাজ্যবাদকে নয়া সাম্রাজ্যবাদ (New Imperialism)-ও বলা হয়।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মধ্যে উপনিবেশ বিস্তারে আকস্মিক আগ্রহ লক্ষ করা যায়। তবে এই উপনিবেশ বিস্তারের কারণগুলি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা একমত নন।

অর্থনৈতিক কারণ

হবসনের মত : ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে এ হবসন তাঁর গ্রন্থ ‘Imperialism-A Study’-তে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেছেন যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ধনবণ্টনের বৈষম্যের জন্য পুঁজিবাদীদের হাতে মাত্রাতিরিক্ত সঞ্চয়ের ফলে মূলধনের প্রাচুর্য দেখা দেয়। এই মাত্রাতিরিক্ত মূলধনের লগ্নির ক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটে। মূলধন লগ্নির জন্যই পুঁজিপতিরা তাদের সরকারকে উপনিবেশ স্থাপনে বাধ্য করে তোলে।

হিলফারডিং-এর মত :
 অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিলফারডিং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্রিয়তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের কারণ খুঁজে পেয়েছেন।

লেনিনের মত: লেনিন তাঁর গ্রন্থ Imperialism: The Highest Stage of Capitalism’-এ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি ‘সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাম্রাজ্যবাদের একটি অংশ। ইউরোপে শিল্পের অগ্রগতির সন্ধ্যে পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে মূলধন সঞ্চিত হয়। উদ্বৃত্ত মূলধন বিনিয়োগে সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভ, শিল্পজাত সামগ্রীর বাজারের অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের পশ্চাতে।

রাজনৈতিক কারণ

আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পশ্চাতে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উপাদানই সক্রিয় ছিল না, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক উপাদানও। ইউরোপীয় জাতিগুলি মনে করত, যত বেশি উপনিবেশ তারা দখল করবে, তাদের শক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদা বাড়বে। বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি উপনিবেশ দখল করে সেই উপনিবেশের জনগণকে সামরিক শিক্ষা দিয়ে নিজ দেশের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বন্ধপরিকর ছিল। অন্যদিকে কোনো কোনো রাষ্ট্র আবার উপনিবেশের সম্পদ আহরণ করে নিজ দেশের অর্থবল বৃদ্ধির চেষ্টা করে। বিশ্বে নৌশক্তিতে আধিপত্য স্থাপনের জন্য সামরিক ঘাঁটি দখল ও জলপথের উপর নিয়ন্ত্রণ আবশ্যিক ছিল। এই সামরিক ঘাঁটিগুলির দ্বারা বাণিজ্য ও রাজনৈতিক আধিপত্যকে সুরক্ষিত করা হত।

অন্যান্য কারণ

খ্রিস্টান মিশনারি, ধর্মপ্রচারক, আবিষ্কারক ও অভিযাত্রীদের কর্মসূচিও উপনিবেশ বিস্তারের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ ধর্মপ্রচারক ডেভিড লিভিংস্টোন (David Livingstone), ফরাসি ধর্মপ্রচারক স্ট্যানলি (Stanley), লেভিজেরি (Levigerie) প্রমুখ ধর্মপ্রচার ও দাসব্যাবসা বন্ধ করতে আফ্রিকায় গেলে এদের ধর্মপ্রচারের সূত্র ধরে ইউরোপীয় বণিকশ্রেণি আফ্রিকায় প্রবেশ করে। ডেভিড থমসন অবশ্য ভৌগোলিক কর্তৃত্ব বাড়াবার স্বাভাবিক স্পৃহা, বাণিজ্যের টান ইত্যাদি কারণগুলির উপরই জোর দিয়েছেন।

Leave a Comment