একটি বর্ষণমুখর দিন প্রবন্ধ রচনা

একটি বর্ষণমুখর দিন প্রবন্ধ রচনা
একটি বর্ষণমুখর দিন প্রবন্ধ রচনা
[রচনা-সংকেত: ভূমিকা- বর্ষণের পূর্বাভাস বর্ষণের আবির্ভাব প্রকৃতির রূপ- ব্যক্তিগত অনুভূতি বর্ষণ থামা উপসংহার] 

ভূমিকা

কদিন ধরেই মনটা বড়ো আইঢাই করছিল। শুধু কি মন? শরীরও নয় কি? উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ-ই হবে। আর সেটা হবে না-ই বা কেন? জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে আষাঢ় এসে গিয়েছে সেই কবে। গরমে নরমে সারা শরীর জুড়ে তপ্ত স্রোতের ধারা। তবু যদি প্রকৃতিদেবীর হুঁশ ফেরে। একফোটা বৃষ্টি নেই কোথাও। শরীরটা যে জুড়াব, তার সাধ্য কী। সেকারণেই আইঢাই। মনে মনে তাই খুব করে চাইছিলাম বৃষ্টি হোক এবং-

‘ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামুক গাছের মাথায়, পাতায় পাতায়

দিক এসে দিক সব ভাসিয়ে’


আমার এই চাওয়াটুকু যেন অন্তর্যামীর মতো শুনতে পেয়েছিল প্রকৃতিদেবী। অতএব আষাঢ়ের এগারোতম দিনেই সে মিটিয়ে দিয়েছে আমার দাবি। জুড়িয়ে দিয়েছে আমার তো বটেই, আরও অনেকের শরীর-মন। দেখিয়ে দিয়েছে তার বর্ষার রূপ। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

বর্ষণের পূর্বাভাস

দিনটা ছিল রবিবার। বেশিদিন আগের কথাও নয়। তাই ভুলিনি কিছুই। আগের দিন রাতে প্রথম দিকে ভ্যাপসা গরমে ঘুমাতে পারিনি। শেষ রাতের দিকে যা একটু ঘুমিয়েছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙল গুরুগুরু গর্জনে আর ঠান্ডা বাতাসের পেলবতায়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বাইরে এসে দেখি-

‘মেঘায় মেঘায় সূর্যি ডোবে

জড়িয়ে মেঘের জাল’

(-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

শুধু যে সূর্যই ডুবেছে, তা নয়, গুরু গুরু গর্জনও ছাড়ছে মেঘগুলো। থেকে থেকে। পাখনার ভেলায় ভেসে যেতে যেতে। মেঘ দেখে বুঝলাম- এ মেঘ বর্ষার। বৃষ্টি হবে।

বর্ষণের আবির্ভাব

আমার ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে একটু বাদেই নেচে উঠল যেন বঙ্গপ্রকৃতির জীবকুল। সেইসঙ্গে বুখাসুখা মাটি আর বিপন্ন গাছপালার দল। কারণ-

‘ছিল যে পরানের অন্ধকারে
এল সে ভুবনের আলোক-পারে।’

ওফ্, সে যে কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি। আমি যেমন করে চেয়েছিলাম ঠিক যেন তেমন করে। টিপটিপ নয়। অঝোর ধারায়। ঝমঝমিয়ে।

(-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 

তখনকার প্রকৃতির রূপ

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম সেই বর্ষণমুখরতায় প্রকৃতির এক মায়াময়তার ছবি। এত ঘনবর্ষায় এবং আকাশভরা মেঘেদের দাক্ষিণ্যে চারদিক অন্ধকার মতো হওয়ার কথা। হয়েছেও তাই। গাছপালাগুলো একটু আগেও বাতাসের বেগে মাথা নাড়াচ্ছিল। এখন যেন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থেকে ভিজছে বেদম। সামনেই একটা আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির জলে স্নান করে চলেছে একটা গোবুও। কাঁচা রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে এর মধ্যেই জলের স্রোত ছুটেছে। এরকম জলে ছোটোবেলায় কাগজের নৌকা ভাসিয়ে কত যে খেলতাম আমরা। সেসব কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। খেয়াল ফিরল মেঘগর্জনের সঙ্গে বিদ্যুৎ-চমক এবং তারপর কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ার শব্দে।

ব্যক্তিগত অনুভূতি

একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে বৃষ্টিপাগল আমি দেখেই যেতে লাগলাম প্রকৃতির সেই বর্ষণগরিমা। মনে পড়ে গেল বর্ষার দিনকে কেন্দ্র করে কবি বিদ্যাপতির লেখা একটি পদ- 
‘কুলিশ শত শত         পাত মোদিত

ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী        ডাকে ডাহুকী 

ফাটি যাওত ছাতিয়া।।’

আমাদের এলাকায় অবশ্য ময়ূর নেই, আশেপাশের পুকুর-ডোবায় ব্যাং অবশ্যই আছে। ডাহুকও। কে জানে, একটু বাদেই হয়তো তাদের ডাক শোনা যাবে। বৃষ্টির ছিটেতে ভিজে যাচ্ছিলাম বলে ঘরে এসে খোলা জানালার কাছে বসলাম একটা চেয়ার নিয়ে। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে একটা সময় দেখি আমার গলায় উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের সেই গান-

‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে 
জানিনে, জানিনে…’

বর্ষণ থামার সময়

প্রথম দিকের প্রবল বেগ পরের দিকে আর না থাকলেও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ ছিল না। হয়েই যাচ্ছিল তো হয়েই যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম সন্ধে পর্যন্ত চলবে। কিন্তু না, বিকেলের পর পরই থেমে গিয়েছিল সেই বৃষ্টি।

উপসংহার

দিনটা মনে রেখেছি এজন্য যে, প্রকৃতির বর্ষার এক অন্য রূপ সেদিন আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। বর্ষার বর্ষণ তো অনেক দেখেছি, কিন্তু সে বর্ষণ? সে যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একেবারেই অন্যরকম।

Leave a Comment